রাবি ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে রাজশাহীতে তীব্র যানজট

  • রাজশাহী ব্যুরো | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২৩, ১২:২৮ পিএম

রাজশাহী: দেশের অন্যতম বৃহৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভর্তি পরীক্ষা চলছে। তিনদিনের এই ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে অতিরিক্ত ৩ লক্ষাধিক মানুষের চাপ বেড়েছে। এতে নির্মল ও শান্ত নগরী রাজশাহীতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। অতিরিক্ত জনসমাগম কে পুঁজি করে ব্যবসায়ী এবং পরিবহণ মালিক শ্রমিকরা গলাকাটা ভাড়া আদায় করছেন। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থেকে আসা পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে নগরবাসীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের বিষয় নিয়ে গঠিত সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সোমবার (২৯ মে) শেষ হয়েছে।  মঙ্গলবার (৩০ মে) কলা অনুষদভুক্ত বিষয় নিয়ে গঠিত বি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সকাল নয়টা থেকে শুরু হয়েছে। চলবে বিকেল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত। সকাল থেকেই নগরীতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন গন্তব্য ও অফিসগামী মানুষরা পড়েছেন চরম বেকায়দায়। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় গাড়িতে বসে থেকে অনেক দেরিতে গন্তব্য স্থলে যাতায়াত করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার ৩ হাজার ৯৩০টি আসনের বিপরীতে তিনটি ইউনিটে চূড়ান্ত পর্যায়ে আবেদন করেছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থী। বুধবার (৩১ মে) তিনদিনের এই ভর্তি পরীক্ষা শেষ হবে। 

রাবির এই ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজশাহীতে আগমন ঘটেছে তিন লক্ষাধিক মানুষের। তবে, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পরিবহণ ও আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যেই, মহানগরের বেশির ভাগ হোটেল-মোটেলের কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেস এবং আবাসিক হলগুলোতেই থাকছেন অধিকাংশ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেকটা গাদাগাদি করেই অবস্থান করছেন। যাতায়াত এবং থাকা নিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়ছেন। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে আয়োজন করতে বাঁধা কোথায়?

গত বছর ভর্তি পরীক্ষার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার জানিয়েছিলেন, শিক্ষার্থী-অভিভাবকগণের ভোগান্তি এড়াতে বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চিন্তাভাবনা আছে। তবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য বলেন, এককভাবে ভর্তি পরীক্ষা না হলে বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি বলে জানিয়েছেন। 

কয়েকটি সূত্র বলছে, প্রশ্নফাঁসের শঙ্কায় ক্যাম্পাসের বাইরে পরীক্ষা নিতে রাজি নন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকগণের একটি বড় অংশ। রাবির এই ভর্তি পরীক্ষাকে ঘিরে শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতেও চলে রমরমা বাণিজ্য। গুঞ্জন আছে, রাজশাহী মহানগরের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের একটি প্রচ্ছন্ন চাপও আছে যেন পরীক্ষাটি ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকে।

এদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে রাজশাহী মহানগরীর হোটেল-মোটেলের ব্যবসা-বাণিজ্য। জানা গেছে, বছরের এই সময়টুকুতেই হোটেলগুলো সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে। আবাসন সংকটকে কাজে লাগিয়ে হোটেলে রুম ভাড়া তিন থেকে চার গুণ বাড়িয়ে গলাকাটা ফি আদায় করছেন হোটেল মালিকরা। ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে হলে এই আয় অনেকটাই কমে যাবে। গুঞ্জন শোনা যায়, মহানগরের প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একটি প্রচ্ছন্ন চাপও আছে বিভাগীয় শহরে যেন পরীক্ষা না হয়। 

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন খান এই প্রচ্ছন্ন চাপের প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্থানীয় যেই রাজনীতি বা প্রশাসন তারা নানাভাবে এডমিশন টেস্টের সাথে ইনভলভ হচ্ছেন। দুঃখের সাথেই বলতে হয়, আমরা দেখি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সমন্বয় সভা হয় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহোদয়ের কার্যালয়ে। অথচ এটা হওয়ার কথা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। অবশ্যই সেখানে মেয়র মহোদয়, স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সমিতিসহ অন্যান্যদেরকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রণ জানাবে এবং আলোচনা করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা যখন হয় আমরা তো দেখি না ঢাবি প্রশাসনকে ঢাকার মেয়র অফিসে যেয়ে আলোচনা করতে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান; ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় স্বাধীনভাবে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিকে পুঁজি করে একটা বড় বাণিজ্য হয় রাজশাহী শহরে—এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

রাবির এই ভর্তি পরীক্ষাকে ঘিরে আনুমানিক কত টাকার বাণিজ্য হয়, এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘এখানে যদি তিন লাখ মানুষের আগমন ঘটে এবং যদি গড়ে ৫ হাজার টাকাও খরচ ধরি তাহলেও তো দেখা যায় কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। তাছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীরা যারা সারা বছর মেসের যেই সিটে থাকে, সেখানে একজন গেস্টকে রাখার জন্য মেস মালিকরা বাড়তি টাকা নেয়। রাজশাহী শহরের মানুষদের এমন বাণিজ্যিক মনোভাব দেশবাসীর কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে বলে আমি মনে করি।’

ঢাকা থেকে ছেলেকে রাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আসা অভিভাবক ইমরান আলী বলেন,  তিন মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগছে একঘণ্টা। পরীক্ষার সময় প্রচুর যানজট লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া সব জিনিসপত্রের দাম বেশি। একশ টাকার জিনিস কিনতে হচ্ছে পাঁচশত টাকায়। ফলে প্রতি অভিভাবকদের একজন পরীক্ষার্থীর পিছনে অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। যা চরম কষ্টকর। 

বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট রয়েছে। এছাড়া, আগামীতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কী সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে তাও বলা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। এসব বাস্তবতায় এ বছর বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।’

বর্তমানে চলমান ভর্তি প্রক্রিয়াটির উপর আস্থা রেখে রাবি উপাচার্য আরও বলেন, এটি একটি কম্পিটিটিভ এক্সাম, এখানে একটু কষ্ট করতেই হয়। ভর্তি পরীক্ষার সার্বিক কার্যক্রমকে আমরা ‘বেস্ট রোবাস্ট’ হিসেবেই মনে করি; এবং এর মাধ্যমে আমরা ভালো শিক্ষার্থীদেরকেই বেছে নিই। তবে যদি ভর্তিচ্ছুদের অতিরিক্ত ভোগান্তি হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। 

সোনালীনিউজ/জেএ/এসআই