অনাগত সন্তানের মুখ দেখার আগেই চিরনিদ্রায় বাবা

  • নরসিংদী প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২৪, ১০:০২ এএম

নরসিংদী: বিয়ে হয়েছে ১৬ বছর আগে। কিন্তু লিজা আক্তার ও সুমন মিয়ার ঘরে কোনো সন্তান আসেনি। বিদেশে চিকিৎসার পর গত বছর অন্তঃসত্ত্বা হন লিজা। গত চার মাস তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাঁর যমজ বাচ্চা হবে; দ্রুতই করা হবে অস্ত্রোপচার। কিন্তু অনাগত সন্তানকে দেখে যেতে পারলেন না সুমন মিয়া।

নির্বাচনের প্রচারণার সময় প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন তিনি। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যানপ্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। 

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেলে উপজেলার সেরাজনগর এম.এ.পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বাদ আছরের পর এবং নিজ গ্রাম চরসুবুদ্ধি ঈদ গাঁ মাঠে বাদ মাগরিব জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

প্রথম জানাজায় পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুল আলম শাহীনের পরিচালনায় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এবিএম রিয়াজুল কবীর কাওসার, সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা মোহাম্মদ আলী, রায়পুরা পৌরসভার মেয়র জামাল মোল্লা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল হাসান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউনুস আলী ভূইয়া, সাধারণ সম্পাদক ইমান উদ্দিন ভূইয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ পার্থ, রায়পুরা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ সাফায়েত হোসেন পলাশ, উপজেলা চেয়ারম্যান ফোরামের সভাপতি ও অলিপুরা ইউপি চেয়ারম্যান আল-আমিন ভূইয়া মাসুদ, সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীনগর ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজ মুর্শেদ খান রাসেল, মির্জাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুঞ্জুর এলাহীসহ জেলা ও উপজেলার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দসহ হাজারও মানুষ।

নিহত সুমন মিয়া উপজেলার চরসুবুদ্ধি ইউপি চেয়ারম্যান হাজী নাসির উদ্দীনের ছেলে। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন তিনি।

এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু নিহত সুমনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, সুমন একজন ভালো ছেলে ছিল। সে খুব মেধাবী ও ছাত্রলীগের সাবেক একনিষ্ঠ কর্মী ছিল। তাকে যারা হত্যা করেছে এবং এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী যারা তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।

প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সুমনের হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে হবে। নয়তো কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া সুমন হত্যার অন্যতম আসামি চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু রুবেলকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে এক লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।

পরে বক্তারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানান। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার না করতে পারলে জেলায় নৌপথ, রেলপথ, সড়কপথে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তারা।

[224034]

নিহত সুমন মিয়া উপজেলার চরসুবুদ্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিনের ছেলে। তিনি এবারের উপজেলা নির্বাচনে তালা প্রতীকের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। তিনি অ্যাগ্রো ফার্ম, পোলট্রি ফিড ও মাছের খামারের ব্যবসা করতেন। নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন। এদিকে হত্যাকাণ্ডের এক দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলা করতে থানায় যাননি নিহতের পরিবারের কোনো সদস্য। তবে বৈধ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় রায়পুরায় নির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।

নিহত সুমন মিয়ার বাবা নাসির উদ্দীন বলেন, সুমনের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রসবের অপেক্ষায় থাকা সুমনের স্ত্রী লিজাকে এখনো ঘটনা জানানো হয়নি। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের খবর জানানোর আগেই তাঁর প্রসব করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রায়পুরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের অঘোষিত ‘দুটি প্যানেল’ তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষে আছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী লায়লা কানিজ ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া। অন্য পক্ষে চেয়ারম্যান প্রার্থী ফেরদৌস কামাল ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসান (রুবেল)। দুই পক্ষের প্রার্থীরা দল বেঁধে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচার চালাচ্ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী সুমন মিয়া ও আবিদ হাসান দুজনই সমর্থকদের নিয়ে বুধবার চরাঞ্চল পাড়াতলীতে জনসংযোগ করছিলেন। চেয়ারম্যান প্রার্থী লায়লা কানিজের সঙ্গে যৌথভাবে প্রচারণায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন সুমন মিয়া। পথে মীরেরকান্দি এলাকায় বেলা দেড়টায় ১৫-২০টি মোটরসাইকেলে করে আবিদ হাসানের একদল কর্মী সুমন মিয়ার দুটি গাড়ির (প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস) পথরোধ করে ভাঙচুর শুরু করেন। তখন সুমনের দেহরক্ষী লাইসেন্স করা শটগান বের করে ফাঁকা গুলি করেন। এ সময় আবিদ হাসানের আরও কর্মী–সমর্থক ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁরা সুমন মিয়া ও তাঁর কর্মীদের মারধর করেন। গুরুতর আহত সুমন মিয়া দৌড়ে জমির আল ধরে পালিয়ে যান এবং প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাঁশগাড়ীর পুলিশ ক্যাম্পে পৌঁছান বেলা সাড়ে তিনটায়।

ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা বিষয়টি রায়পুরা থানার ওসিকে জানান। ওসি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু খবর পেয়ে আবিদ হাসানের কর্মী-সমর্থকেরা হাসপাতালের গেটে মিছিল নিয়ে ওই অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখেন। পরে ওসি সাফায়েত হোসেন সেখানে গিয়ে ওই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বাঁশগাড়ীর উদ্দেশে রওনা হন। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে বাঁশগাড়ী ফাঁড়ি থেকে ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে সুমন মিয়াকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা খান নুরউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর জানান, হামলা হওয়ার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর সুমন মিয়াকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তাঁর মাথায়-নাকে-মুখে আঘাত করা হয়েছিল। নাক দিয়ে রক্ত ও তাঁর মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। প্রাথমিকভাবে এটুকু বলা যায়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে।

এমএস