এমপির বিরুদ্ধে মামলা: সাঁওতালরা অবরুদ্ধ!

  • গাইবান্ধা প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০১৬, ১২:৫৪ এএম

গাইবান্ধা: রংপুর চিনিকলের জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ঘটনায় স্থানীয় এমপিকে আসামি করে থানায় অভিযোগের পর নিরাপত্তার নামে কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে সাঁওতালদের। এ অভিযোগ করছেন স্থানীয় সাঁওতালরা। 

মাদারপুরে গির্জার মাঠ ও স্কুলে আশ্রয় নেয়া সাঁওতালদের অভিযোগ, তাদের গ্রাম থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি অভিযোগ থেকে স্থানীয় এমপির নাম বাদ দিতে চাপও দেয়া হচ্ছে। এজন্য তারা দুষছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে। 

গত ৬ নভেম্বর হামলার পর দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা জানানো হয় সমতলের এই নৃগোষ্ঠীর মানুষদের। 

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের পক্ষে থোমাস হেমরম বাদী হয়ে গত ২৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ থানায় অভিযোগ দাখিলের পর থেকে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। 

তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই অভিযোগ থেকে এমপির নাম প্রত্যাহারের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে এমপির লোকজন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি সাঁওতালদের হুমকি দিচ্ছে।

মাদারপুর গ্রামের বার্নাবাস টুডু বলেন, মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম দুটি ঘিরে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজন ঘোরাফেরা করছে। এদের কাজ হলো সাঁওতালদের বাইরে যেতে বাধা দেয়া ও অন্য কাউকে গ্রামে ঢুকতে না দেয়া। ফলে প্রায় এক মাস ধরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছি আমরা। 

সাঁওতালদের অভিযোগ, মামলার অভিযোগ থেকে সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের নাম প্রত্যাহারের জন্য নানারকম চাপ দেয়া হচ্ছে। সংসদ সদস্যের নাম প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হয়েছে গোবিন্দগঞ্জে। 

সাঁওতালদের চলাচলে বাধার অভিযোগের বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, চলাচলে কোনো বাধা নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগও আমার জানা নেই।

গত শনিবার সংসদ সদস্য আবুল কালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে সমাবেশ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। গোবিন্দগঞ্জ প্রেস ক্লাব চত্বরে এই সমাবেশে সাঁওতালদের করা অভিযোগের আসামি জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন ফকুও ছিলেন। 

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘এলাকার লোক আমাকে ভালোবাসে। তাদের মধ্যে কে কখন কাকে হুমকি কিংবা বাধা দিচ্ছে, এটা তো আমি জানি না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সাঁওতালদের ব্যবহার করে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।’

গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে আখ কাটতে গেলে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন সাঁওতাল মারা যান, আহত হন অনেকে। পরে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে সাঁওতালদের ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলসংলগ্ন গ্রামটিতে গত শনিবার গিয়ে দেখা যায়, গির্জার সামনের মাঠে কেউ কেউ কলাগাছের পাতা দিয়ে ছোট ছোট কুঠুরি বানিয়ে, আবার কেউবা ত্রাণ হিসেবে পাওয়া তাঁবু টানিয়ে বসবাস করছে। অনেকে থাকছেন পরিত্যক্ত স্কুলঘরে খড় বিছিয়ে। 

মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দা রুমিলা কিসকু বলেন, ‘আমাদের ওইদিকে (ইক্ষু খামার) যাইতে দেয় না। গত ২৯ দিনেও আমরা ওইদিকে যাইতে পারি নাই। আপনারা আসছেন বলে এইখানে (মাঠের পাশে) দাঁড়াইতে দিছে। না হলে গালি দিয়ে সরাই দিত।’ রুমিলা কিসকু উচ্ছেদের জন্য চিনিকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুলিশকেও দায়ী করে বলেন, প্রশাসনের লোকেরা এবং পুলিশ প্রথমে আগুন দেয়, পরে গুলি চালায়।  

সরেজমিনে সাঁওতালদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘর হারানো কয়েকশ সাঁওতাল এখন ত্রাণের ওপর নির্ভর করে চলছে। তারা বলেন, ত্রাণ পেলে রান্না হয়। নাহলে বেশির ভাগ চুলায় আগুন জ্বলে না।  

খোলা মাঠে ঠাঁই নেয়া কোমল ফুলমতি মুরমু (৫৫) বলেন, ওইদিন তার কাঁথা-বালিশ-তোশক সব পুড়ে গেছে। এখন চাল নেই, চুলো নেই। কেউ দিলে খান, না দিলে না খান। 

এদিকে উচ্ছেদের পর সাঁওতালদের চাষ করা ধান আদালতের নির্দেশে তাদের বুঝিয়ে দিতে শুরু করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। গত শনিবার পুলিশ পাহারায় সাঁওতালদের চাষ করা ধান দ্বিতীয় দফায় কাটা শুরু হয়েছে। জমিতে ওই দিনই মাড়াইয়ের পর ৫০ বস্তা ধান সাঁওতালদের বুঝিয়ে দেয়া হয়।

গত শনিবার বিকেলে মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া সাঁওতাল পল্লীর ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৫শ কম্বল ও ৪শ লুঙ্গি বিতরণ করে সাফিয়া আসাফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শামীম কায়সার লিংকন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গোবিন্দগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি ফারুক আহমেদ, সাফিয়া আসাফ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম, মোতাকাব্বের আলী, আনারুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম।

সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের এক হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তোলে। স¤প্রতি চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওইসব জমি লিজ দিলে তাতে ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ শুরু হয়। প্রায় দুই বছর আগে সাঁওতাল ও স্থানীয় কিছু বাঙালি হিন্দু-মুসলমান চিনিকলের বিরুদ্ধে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ এনে তাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এর একপর্যায়ে সাঁওতালরা খামারে বসতি গড়ে তোলে।

সংঘর্ষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই কল্যাণ চক্রবর্তী বাদী হয়ে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে ৩শ জনকে আসামি দেখিয়ে মামলা করেন। এরপর গত ১৬ নভেম্বর স্বপন মুরমু বাদী হয়ে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে একটি মামলা করেন। তবে নিজেদের সম্প্র্রদায়ের এই ব্যক্তির মামলা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সাঁওতালদের। এরপর গত ২৬ নভেম্বর সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত থোমাস হেমরম বাদী হয়ে স্থানীয় এমপি, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে থানায় মামলার আবেদন করেন। 

এ মামলা সম্পর্কে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, এর আগে সাঁওতালদের পক্ষে স্বপন মুরমু বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। একই ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে থোমাস হেমরমের দেয়া এজাহারটি জিডিভুক্ত করে তদন্তের কাজ চলছে বলে জানান ওসি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি