উপকূলে ৩২ বছরে কমেছে ২৮৫ প্রজাতির পাখি

  • ভোলা প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০১৯, ০৭:৪৬ পিএম

ভোলা : জেলার চরাঞ্চলগুলোতে অতিথি পাখিরা এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। সুদূর হিমালয় ও সাইবেরিয়াসহ উওরের শীত প্রধান দেশ মঙ্গোলিয়া, নেপাল, জিনজিয়াং থেকে আসা হাজার হাজার অতিথি পাখির ভিড়ে দ্বীপ জেলা ভোলাসহ উপকূলের চরাঞ্চলগুলো সেজেছে ভিন্ন রূপে।

শীতের সকাল-বিকেল জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এসব চরাঞ্চলগুলোতে অতিথি পাখির কলকাকলি, কিচিরমিচির, উড়ে বেড়ানো আর জলকেলীতে একদিকে যেমন ছুয়ে যায় কঠিন হদয়ের মানুষের মন, অন্যদিকে নিছন সখ ও লালশার বশবর্তী হয়ে এক দল প্রভাবশালী শিকারী ভিড় জলায় উপকূলের এসব চরাঞ্চলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৮০’র দশকে ভোলায় আসা অতিথি পাখির সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫০ প্রজাতির। কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা নেমে ৬৫ প্রজাতিতে চলে এসেছে। প্রতিবছরই শীতের শুরুতে হাজার পাখির কলকাকলীতে এ অঞ্চল মুখরিত হয়ে উঠলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে দিন দিন এর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে এভাবে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমতে থাকলে এক সময় ভোলার চরাঞ্চলগুলোতে অতিথি পাখির জলকেলী আর কলতান ফুরিয়ে যাবে।

১৮ জানুয়ারি ঢাকা থেকে ভোলায় পাখিশুমারী করতে আসা বন্যপ্রাণী গবেষক ও পাখি পর্যবেক্ষক সামিউল মোহসেনিন জানান, গত শীত মৌসুমে সর্বমোট ৫০ হাজার ৪০টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি গণনা করেছেন। এর মধ্যে ৬৬ প্রজাতির পাখির সন্ধান মিলেছে। যার মধ্যে জলচর পাখি ছিল ৬৫ প্রজাতির। সর্বমোট সৈকত পাখির সন্ধান মিলেছে ৪ হাজার ৪২১টি।

যার মধ্যে চেগা, জিরিয়া, বাটান ছিল উল্লেখ যোগ্য। বনু হাসের সন্ধান মিলেছে ১২ হাজার ৮৭৩টির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিথি হাস, বেবী, চকাচকি, রাজ হাঁস।

অন্যদিকে এ বছর শীত মৌসুমে মোট ৬৫ প্রজাতির ৫৬ হাজার ৫২২টি জলচর পাখি দেখা গেছে। এর মধ্যে ৫ প্রজাতির বিপন্নপ্রায় জলচর পাখি দেখা গেছে, এর মধ্যে মহা বিপন্ন চামুচ ঠুটো বাটান ৫টি। বিপন্ন নর্ড ম্যানের সবুজ পা ২টি।

সংকটাপন্ন দেশি গাঙচষা ১৩ হাজার ৪৩টি। এ ছাড়া প্রায় সংকটাপন্ন প্রজাতির মধ্যে নদীয়া পানচিল ৬টি, এশীয় ডউইচার ২৮টি, কালা লেজ জৌরালি ৫ হাজার ৪২৭টি, কালামাথা কাস্তেচরা ৪৫৫টি, ইউরেশীয় গুলিন্দা ৩১৩টি, ইউরেশীয় গুলিন্দা ৩৩১টি। ১০ প্রজাতির বনু হাসের সন্ধান মিলেছে ১৪ হাজার ৭৯৬টির।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দাগি রাজহাস, সিথি হাঁস, খুন্তে হাঁস, পিয়াং হাঁস, খয়রা চখাচখি, পাতি চখাচখি, উত্তরের ল্যাঞ্জা হাঁস, মড়চে রঙা ভুতি হাস ও মেটে রাজ হাঁস।

তিনি উপকূলের মোট ২০টি চর পর্যবেক্ষণ করেছে। এর মধ্যে মাঝের চর, পাতার চর, দমার চর, শাহাজালাল, কালকিনির চর, চর কুকরি-মুকরি, চর পিয়াল, চর পাতিলা, আন্ডার চর, সোনার চর, চর মনতাজ, টেগরার চর, সালুর চর, ডুব চর, ও বঙ্গের চরে এ পাখিদের বেশি সংখ্যায় দেখা গেছে। তবে তিনি দুঃখ করে বলেন, মাঝের চর, বঙ্গের চর ও সালুর চর এ পাখি শিকারের প্রমাণ ও নমুনা পাওয়া গেছে।

বেশির ভাগ শিকারিরাই ভোলার বাইরে থেকে আসে এবং শখের বশে পাখি শিকার করে বলে স্থানীয়রা তার কাছে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, পরিযায়ী পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ও একটি সুস্থ পরিবেশের সূচক স্বরূপ।

দিন দিন পাখি কমে যাওয়ার পেছনে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বড় কারণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক। তিনি জানান, বাংলাদেশে ৩০ বছর আগে যেখানে ফসল শুধু জৈব সার ব্যবহার করা হতো।

এখন সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সার। যেটা পাখিদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। আবার এক শ্রেণীর অসাধু শিকারীরা বিষ দিয়ে পাখি নিধন করে বাজারে বিক্রি করেছে। যার ফলে পাখিরা থাকা ও খাওয়ার জন্য অনেক স্থানকে এখন আর নিরাপদ মনে করছে না। প্রকৃতি ও পাখি বিশেষজ্ঞ ড. এস এম এ রশিদের সঙ্গে কথা হয়।

যিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম পাখি শুমারি শুরু করেন। তিনি বলেন, ৮০’র দশকে ভোলায় আসা অতিথি পাখির সংখ্যা যেখানে ছিল প্রায় ৩৫০ প্রজাতির তা এখন নেমে ৬৫ প্রজাতিতে চলে এসছে। কথা হয় পাখি-পর্যবেক্ষক ও পর্বত আরোহী এম এ মুহিতের সঙ্গে। ফলে পাখিদের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে গরু-মহিষ ও জেলেদের অবাধ বিচরণ।

এ ছাড়াও মেঘনা তেতুলিয়া নদী বেষ্টিত এসব চরাঞ্চলে গাছের সবুজ বেষ্টনি একের পর এক উজাড় হচ্ছে। কিছু অসৎ বনরক্ষীর সহযোগিতায় দিনের আলোতে প্রকাশ্যেই বনের গাছ লুট করছে দস্যুরা। যার ফলে পাখিরা এখন ওইসব চরগুলোকে তাদের নিরাপদ স্থান বলে মনে করছে না।

এ ছাড়াও নদীগুলোতে জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে মাছ শিকার করছে। যে কারনে একদিকে যেমন পাখিদের খাদ্যপযোগী মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে, জালে জড়িয়ে অনেক পাখিও প্রান হারাচ্ছে।

তিনি দুঃখ করে বলেন, কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা প্রতিহত না করা গেলে ওই সব মাছের বংশ এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি নিয়াজ আবদুর রহমান বলেন, পাখিদের আবাসস্থল এখন লোকালয়ে পরিণত হয়েছে। পাখিদের কোলাহল মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্রগুলো এখন প্রভাবশারীদের দখলে দিন দিন মানুষ বাড়ছে। মাছের চাহিদা বাড়ছে। তাই এখন জেলেদের সংখ্যাও বেশি। জেলেরা কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরছে। নদীতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। ফলে নদীর প্রাণ বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।

এ সময় তিনি নদীর প্রাণ বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে সকলকে এক যোগে কাজ করার আহবান জানান। উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, শীত মৌসুমে উপকূলীয় চরগুলোতে আসা  পাখির বিচরণ ক্ষেত্রগুলো রক্ষার জন্য বন বিভাগ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে উপকূলে আসা পর্যটকদের পাখি দেখার জন্য ভোলার চর কুকরি-মুকরিতে বার্ড ওয়াচ সেন্ট তৈরির একটি প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর