সংবাদ প্রকাশের পর

শিকলে বাঁধা মা এখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন

  • ঝালকাঠি প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১৩, ২০১৯, ০৬:১০ পিএম

ঝালকাঠি : ‘একটু শিকলের বাঁধন খুলে দাও, আমি কোথাও যাবো না। আমাকে এভাবে বেঁধে রেখ না, আমার ভাল লাগে না। কেউ ভাল করে খেতেও দেয় না, তরকারি দেয় না। আমায় একটু মিষ্টি খেতে দাও।’ ভাঙা ভাঙা শব্দে এভাবেই বিলাপ করছিলেন ঝালকাঠির রাজাপুরের উত্তর বারবাকপুর গ্রামের বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম। তার এ দুঃখ দুর্দশা ও দুর্বিসহ জীবনের ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে উপজেলা প্রশাসনের।

সোমবার (১৩ মে) সকাল পৌন ১১টার দিকে ওই উপজেলার উত্তর গ্রামের নুর মোহাম্মদের বাড়ির মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব পাশের ইউনুচ মৃধার পরিত্যক্ত ভিটায় অরক্ষিত অবস্থায় থাকা ওই শিকল বন্দি মা রিজিয়া বেগমের কাছে যান ইউএনও মোঃ সোহাগ হাওলাদার। খুলে দেন তার কোমড়ের শিকল ও তালা। ৪ বছরের শিকল বন্দিদশা থেকে মুক্তহন ৭৫ বছর বয়য়সী রিজিয়া বেগম। এরপর তার স্বজনরদের ৫শ টাকা দিয়ে গাড়িভাড়া দিয়ে তাকে দুপুরে রাজাপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি এবং চিকিৎসার পরামর্শ দেন। কিন্তু যে সন্তানদের তিলে তিলে বড় করে তুলেছেন তারাই তাদের মাকে অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে শিকলবন্দি রেখেছিলেন। রেখেদিয়েছিলো একটি জীর্ণ ঘরে। সারাদিনে খাবার জোটে মোটে একবেলা। এভাবেই চার বছর ধরে দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি।

রাজাপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের টিএইচও ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় বৃদ্ধ রিজিয়া বেগম দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাকে ভিটামিন ও ঘুমের ঔষধ দেয়া হচ্ছে। তার এখন প্রচুর রেস্ট নেয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তার মানুষিক পরিস্থিতি বুঝে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হবে। সবচেয়ে ভাল হয় বরিশাল, খুলনা বা ঢাকা শেরে বাংলা নগর মানুষিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউট চিকিৎসা দিলে ভাল হয়।

টিএইচও ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষিক সমস্যা। মানুষিক ও স্বাস্থ্য ভাল না বিধায় মনোদুর্বল। এটা অনেক সময় বংশগত হয় অথবা কোন নিকটাত্মীয় মারা গেলে মানুষের এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। আবার অনেক সময় মানুষিক দুশ্চিন্তা দেনশন থেকে হয়। বিশেষ করে ছেলে মেয়েরা কথা না শুনলে বা সেবাযত্ন না করে। এদের মূল সমস্যা হল ঘুম কম হয় আবার অনেক সময় ঘুম হয়না। এটা অনেক সময় বর্ষা ও গরমের দিনে মানুষিক অবস্থা খুবই দুর্বল থাকে, বছরে দুই বার আক্রান্ত হয়। এটা একধরনের কৌনিক সমস্যা।

ইউএনও মোঃ সোহাগ হাওলাদার জানান, সমকালে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি প্রশাসেরন নজরে আসে, তাই তার শিকলের বাধন খুলে উদ্ধার করে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগীতা করা হবে।

এছাড়া বয়স্ত ভাতা, বিধবা ও ৩০ কেজির চালসহ যাবতীয় সুবিধা দেয়া হবে। পরবর্তীতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তার আবাসন ও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।

রিজিয়া বেগমের ছেলে রাজ্জাক শেখ জানান, চার বছর আগে ঘুমের ঘোরে তার মা হঠাৎ ব্রেইন স্ট্রোক করেন। তারপর তার মাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন স্থানের ডাক্তার দেখিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। এরপর মাকে আর অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। এ অবস্থায় তার মা দিন দিন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিরুপায় হয়ে প্রায় চার বছর ধরে লোহার শিকলে তালা লাগিয়ে ওই ঘরটি নির্মাণ করে সেখানে রাখেন। মাকে নিজ ঘরেও রেখেছিলেন।

কিন্তু তখন ঘরের আসবাবপত্র ভাংচুর করতেন তিনি। পায়খানা-প্রস্রাব করে নোংরা করতেন। এ জন্য নিরুপায় হয়ে এখন ওই ঘরেই রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তার অভাবের সংসার চালিয়েও সাধ্য মতো মায়ের সেবা করে যাচ্ছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বহুদিন ধরনা দিয়েও কোনো সাহায্য পাননি।

এমনকি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা কোনো উপকারভোগী কার্ড দেননি মেম্বার-চেয়ারম্যানরা। তাই নিরুপায় হয়ে গাছের ডালে টিনের চালা দিয়ে ও সিমেন্টের ব্যাগের কাগজের বেড়া দেওয়া ঘরে কাঠের চৌকিতে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন তিনি। ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গরমে পরিত্যক্ত ভিটার ওই খুপরিতেই জীবনযাপন করতেন। মশার কামড় সহ্য করতেন হচ্ছে দিনের পর দিন। খড়ের গাদার আড়ালে তার ঘরে লোকের পদচারণা নেই বললেই চলে। রিজিয়ার দুই সন্তান সচ্ছল নন। অসুস্থ মায়ের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওই ঘরে রেখে এসেছেন তাকে।

জানা গেছে, প্রায় ২০ বছর আগে স্বামী আব্দুল নিজাম উদ্দিন শেখকে হারান রিজিয়া। তার এক ছেলে আব্দুর রাজ্জাক শেখ পেশায় কামার এবং মেয়ে সালমা বেগম গৃহিণী। সালমার স্বামী উপজেলার রোলা গ্রামের দিনমজুর শুক্কুর হাওলাদার। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় মেয়ে সালমাও মায়ের তেমন খোঁজখবর নিতে পারেন না। ছেলে রাজ্জাকও কামারের কাজ করে কোনমতে চার সন্তানের পরিবার নিয়ে অতিকষ্টে সংসার চালাচ্ছেন।

চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসা রিজিয়ার পুত্রবধূ নাছিমা বেগম জানান, ইউএনও স্যার ৫শ টাকা দিয়েছে তা দিয়ে তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এনে ভর্তি করেছি। আমরা চাই সকলের এ সহযোগীতা অব্যাহত থাকুক এবং তার সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি সুস্থ্য হোক। আমরা সবাই গরীর নিজেরাই খেতে পারি না, তাই তাকে চিকিৎসা করাতে সহলের সহযোগীতা প্রয়োজন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই