আলোচিত ৫ মে

এগুচ্ছে না হেফাজতের বিরুদ্ধে অর্ধশত মামলা

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ৪, ২০১৬, ০১:৩৩ পিএম

অপর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে এগুচ্ছে না হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের বাদী হয়ে করা অর্ধশত মামলা। পুলিশের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩টি মামলার চার্জশিট দেয়া হলেও, ডিবির মামলাগুলো সব ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে- যেমনটি চলছে এখনকার হেফাজত; শুধু প্রেসরিলিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। হেফাজতের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর নামে করা মামলাগুলোর তৃতীয় বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার।

২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, পল্টন, রমনা, শাহবাগ, কলাবাগান ও শেরে বাংলা নগর থানা এলাকায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। এর জেরে রাজনীতির অনেক হিসাব নিকাশ তখন পাল্টে গেছে। বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ ঘটনায় ওই রাতেই অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করে পুলিশ ও ব্যবসায়ীরা বাদী হয়ে মামলা করেন।

মামলার এজাহারের বিবরণ ও হিসাব অনুযায়ী, হেফাজতের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি দোকান, ব্যাংক, একাধিক ব্যাংকের এটিএম বুথ, সরকারি গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেল, পিকআপসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অর্ধশতাধিক কোটি টাকা। হেফাজতের তাণ্ডবে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে ১০ হাজারেরও বেশি পরিবার। হাজার হাজার বই ও পবিত্র কোরান-হাদিসেও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। কেটে ফেলা হয়েছিল রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনকারী শত শত গাছ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মোট ৫৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে এ বছরের শুরুতে রমনা থানা পুলিশ ১টি এবং কলাবাগান থানা পুলিশ ২টি মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয়। বাকি ৫০টি মামলা এখনো তদন্তাধীন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মামলা রয়েছে পল্টন থানায়। সেখানে রয়েছে ২৪টি মামলা। এছাড়াও মতিঝিল থানায় ৩টি, রমনায় ২ টি, শাহবাগে ৩টি, যাত্রাবাড়ীতে ৩টি এবং ধানমণ্ডি থানায় রয়েছে ১টি মামলা।

ডিবির হিমাগারে ১৫ মামলা: হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখনো তদন্তাধীন ৫০টি মামলার মধ্যে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হিমাগারে রয়েছে ১৫টি। ওই দিনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর মামলাগুলোর তদন্তভার তাদের দেয়া হলেও একটির চার্জশিট দেয়া হয়নি। ডিবির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ১১ থেকে ১৩, ১৮ এবং ৪২ নম্বর মামলার তদন্তের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ১১ ও ১২ নম্বর মামলায় হামলা, বিস্ফোরক বহন ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। মতিঝিল থানায় দায়ের করা ১৩ নম্বর মামলাটি ছিল থানায় হামলা ও বিস্ফোরক উপাদান-সংক্রান্ত। ১৮ নম্বর মামলাটি ছিল পল্টন থানায় আহাদ পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনা। ৪২ নম্বর মামলায় হামলা ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। বাকি দু’টি মামলার নম্বর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

ডিবির হাতে তদন্তে থাকা মামলার মধ্যে পুলিশের উপ-পরিদর্শক এসআই শাহজাহান হত্যা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিয়া গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ডিবির হাতে তদন্তে থাকা মামলাগুলোর প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ ও ভিডিও ফুটেজের সীমাবদ্ধতার কারণে তদন্তে সময় লাগছে। আমরা ইতিমধ্যেই একটি মামলায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দও করেছি। কিন্তু মামলাগুলো স্পর্শকাতর হওয়ায় চার্জশিট দিতে একটু সময় লাগছে।’
যদিও সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ প্রায় সব টেলিভিশন এবং অনলাইন পত্রিকায় লাইভ সম্প্রচার করা হয় এবং পরের দিন জাতীয় দৈনিকগুলোকে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন থানায় তদন্তাধীন ৩৫টি মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার ডিসি মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘পুলিশ যথা নিয়মেই মামলাগুলোর তদন্ত করছে। ইতিমধ্যেই দেখেছেন ৩টি মামলার চার্জশিট আদালতে দেয়া হয়েছে। অন্যগুলোরও দেয়া হবে। তবে যেহেতু মামলাটি তুলনামূলক স্পর্শকাতর, তাই একটু সময় লাগতেই পারে।’
এদিকে তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৫ মে কোনো কর্মসূচি আছে কি না জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসলামে দিবস উদযাপনের কোনো বিধান নেই, তাই আমরা ৫ মে বিশেষ কোনো কর্মসূচি দিচ্ছি না। তবে বিভিন্ন মসজিদ মাদরাসায় শহীদদের জন্য দোয়া পাঠ করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে আমরা যোগযোগ করেছি। সাধ্যানুযায়ী তাদের সহযোগিতাও করার চেষ্টা করেছি।’

শহীদদের তালিকা প্রকাশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজিজুল হক ইসলামবাদী বলেন, ‘শহীদদের তালিকা প্রকাশের দায়িত্ব সরকারের। তারা বন্দুকের নল থেকে দেড় লাখ গুলি ছুড়েছে। এই গুলি গেলো কোথায়? সরকারকে জবাব দিতে হবে। তারা বিনা বিচারে আমাদের কর্মীদের ওপর গুলি চালিয়েছে।’ সংগঠন রাজনীতিতে সক্রিয় হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমরা ইসলামের হেফাজত করবো। রাজনীতির হেফাজত করা আমাদের দায়িত্ব না।’ যদিও বিগত স্থানীয় নির্বাচনে সরাসরি হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে রাজশাহী ও গাজীপুর পৌরসভায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজিজুল হক বলেন, ‘মামলার বিষয় আদালত জানে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।’
হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর সাথে মুঠোফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রচণ্ড অসুস্থ। এই মাত্র হাসপাতাল থেকে আসলাম। কথা বলার মতো অবস্থা নেই।’

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৫ মে নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির বিধান রেখে আইনপ্রণয়নসহ ১৩ দফা দাবিতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয় হেফাজতে ইসলাম। ওই দিন মধ্যরাতে রাতেই ১৫ মিনিটের অভিযানে তাদের ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি। রাতে অভিযানের পর জনতা পাঁচজন এবং পুলিশ দুইজনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন বলে হাসপাতাল ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক জানান।

নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক ছাত্র ছিলেন। তার নাম একেএম রেহান হাসান (২২)। তিনি বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র ছিলেন বলে তার স্বজনরা দাবি করেছিলেন।

এছাড়া ভোরে রাজারবাগ এলাকায় মো. শাজাহান নামের এক পুলিশ উপ পরিদর্শককে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মৃত্যু হয় তার। তবে হেফাজত নেতারা দাবি করেছিলেন, অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অন্তত আড়াই হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ তারা হাজির করতে পারেননি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ/এমটিআই