ঢাকার হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের কাছে দুটি নীল রঙের ড্রাম থেকে উদ্ধার হওয়া খণ্ডিত লাশ শনাক্ত হওয়ার পর দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ব্যবসায়ী আশরাফুল হক হত্যা মামলা। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ড্রামের ভেতর থেকে মোট ২৬ খণ্ডে বিভক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জরেজুল ইসলাম এবং এক নারী শামীমা আক্তার।
সম্পর্কের টানাপোড়েনই হত্যার প্ররোচনা
তদন্তে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, আশরাফুল হক, জরেজুল ইসলাম ও শামীমা আক্তারের মধ্যে গড়ে ওঠা জটিল ত্রিভুজ সম্পর্কই এ হত্যার মূল কারণ। তিন বছর আগে ফেসবুকের মাধ্যমে মালয়েশিয়া ফেরত জরেজুলের সঙ্গে পরিচয় হয় কুমিল্লার গৃহবধূ শামীমার। জরেজ দেশে আসার পর তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পরে জরেজুলের মাধ্যমে শামীমার সঙ্গে পরিচয় হয় ব্যবসায়ী আশরাফুলের, এবং ধীরে ধীরে তাদের মধ্যেও সম্পর্ক তৈরি হয়।
এ সম্পর্ক জানাজানি হতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জরেজ। ডিবির তথ্যমতে, ঘটনার দিন দক্ষিণ ধনিয়ায় ভাড়া নেওয়া বাসায় আশরাফুল ও শামীমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তিনি বাসায় লুকিয়ে থাকেন। রাত গভীর হলে দুজনের ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ায় ক্রোধে ফেটে পড়েন জরেজ। প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে এবং পরে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করে আশরাফুলকে হত্যা করেন। এ সময় শামীমাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
২৬ খণ্ডে বিভক্ত মরদেহ, দুটি ড্রামে
হত্যার পর মরদেহ দুইদিন বাসায় রেখে পরে ২৬ টুকরো করা হয় বলে জানা যায়। টুকরোগুলো দুটি ড্রামে ভরে ঈদগাহ মাঠের সামনে ফেলে রেখে দুজন কুমিল্লায় পালিয়ে যান। স্থানীয়দের চোখে পড়ে ড্রাম দুটি, পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. দীপিকা রায় জানান, গলা থেকে নিচ পর্যন্ত ২৫টি অংশ এবং মাথা মিলিয়ে মোট ২৬ খণ্ড উদ্ধার করা হয়েছে। কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত থাকলেও ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শুক্রবার রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা থেকে জরেজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। একই সময় র্যাব-৩ দল লাকসাম থেকে শামীমা আক্তারকে আটক করে। দুইজনকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে ডিবি নিশ্চিত করেছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, পরকীয়া ঘিরে দ্বন্দ্ব থেকেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মরদেহ উদ্ধারের পরপরই আমরা তদন্ত শুরু করি এবং দ্রুত মূল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।
নিখোঁজ থেকে লাশ শনাক্ত—আতঙ্কে পরিবার
পরিবার জানায়, গত ১১ নভেম্বর রাতে ব্যবসার কাজে ঢাকায় আসেন আশরাফুল। এরপর তার মোবাইল বন্ধ পাওয়ায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে। ১৩ নভেম্বর গণমাধ্যমে ড্রামে খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের খবর দেখে স্বজনরা শাহবাগ থানায় গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন।
আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় জরেজুলকে প্রধান আসামি করেন। তিনি অভিযোগ করেন, পূর্ব পরিকল্পনা করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে মরদেহ খণ্ডিত করে ড্রামে ভরে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় ঘাতকরা।
ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও অর্থলোন নিয়ে জটিলতা
পরিবারের দাবি, মালয়েশিয়ায় থাকার সময় থেকেই জরেজুলের সঙ্গে আশরাফুলের ঘনিষ্ঠতা ছিল। দেশে ফেরার পর তিনি আশরাফুলের ব্যবসায়িক হিসাবনিকাশও দেখাশোনা করতেন। সম্প্রতি বিদেশ যাওয়ার জন্য জরেজুল আশরাফুলের কাছে ১০ লাখ টাকা ধার চান— এমন অভিযোগ করেন নিহতের স্ত্রী লাকী বেগম।
তিনি বলেন, জরেজুলই আমার স্বামীকে ঢাকায় এনেছিল। তারপর তার ফোন ধরে মিথ্যা কথা বলেছে। আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে সে।
পেঁয়াজ, আলু, রসুনসহ কাঁচামাল পরিবহনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আশরাফুল। দেশজুড়ে পাইকারি সরবরাহ নেটওয়ার্ক ছিল তার। কেন, কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটল— সে বিষয়ে তদন্ত এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছে ডিবি।
এম