এমএলএমের আড়ালে এসএম ট্রেডিংয়ের প্রতারণায় নিঃস্ব গ্রাহক

  • নিজস্ব প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২০, ০৭:১২ পিএম
ছবি: প্রতিনিধি

ঢাকা : ডিলার নিয়োগ, ফ্ল্যাট বিক্রি, ব্যবসায়ীক পাটনার ও অতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভনে ফেলে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে  ‘এসএম ট্রেডিং’ নামে একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির বিরুদ্ধে।

এ অভিযোগের পর অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এসএম ট্রেডিংই নয়, এমন প্রায় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে রাজধানী জুড়ে। মার্কেটে নেই কোনো পণ্য তারপরও ডিলারশিপ নিয়োগ, ফ্ল্যাট বিক্রি ও মূলধনসহ মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে গ্রাহকের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা।

জানা গেছে, দেশে বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) পদ্ধতির সব কোম্পানিই এখন বেআইনি। সরকার লাইসেন্স দিয়েছে, এমন একটিও এমএলএম কোম্পানি আর নেই।

এসএম ট্রেডিংয়ের প্রতারণার শিকার কাউছার নামের এক ভুক্তভোগী জানান, ডিলারশিপ নিয়োগ দেয়ার নামে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। চালের ডিলারশিপ নেয়ার জন্য  ২ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে উত্তরার অফিসে এসে জমা দেন। পরে বলা হয় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য পৌঁছে যাবে, কিন্তু কয়েক মাস কেটে গলেও পণ্য আসেনি।

 

তিনি আরো জানান, টাকা চাইতে অফিসে এলে তাকে গুম করে দেয়ার হুমকি দেয় কোম্পানির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন ওরফে শুভ চৌধুরী ও কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলী হাসান পলাশসহ কয়েকজন। এছাড়া সাদা কাগজে তার স্বাক্ষর নেয় তারা।

সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মী ও পুলিশের সহযোগিতায় ওই ভুক্তভোগী এলে এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে।

তুর্ণা নামের আরেক ভুক্তভোগী জানান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেষ সম্বল বাবার পেনশনের টাকা শুভ চৌধুরীর কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে এখন পথে বসেছে পুরো পরিবার। 

তিনি বলেন, নগদ, চেক ও বিকাশের মাধ্যমে শুভ চৌধুরীকে ১৫ লাখ টাকা দেই। এখন লাভসহ প্রায় ২২ লাখের মত টাকা পাওনা। এখন সে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না, ফোনও ধরছেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, পল্টন, মতিঝিল, কুড়িল বিশ্বরোডসহ সাতটি এলাকায় অফিস খুলে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে আসছে প্রতারকরা।

এসএম ট্রেডিংয়ের আর এক ভুক্তভোগি মিসেস ফাতেমা মজুমদার জানান, ব্যবসায়ীক পার্টনার বানানোর কথা বলে তিন লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা শুভ চৌধুরী। কোন ভাবেই টাকা দেয় না। সরাসরি গণমাধ্যমের সহযোগিতায় তাদের অফিসের নিচে ধরতে পারি শুভর আর একটা পার্টনারকে। পুলিশ ও সাধারাণ মানুষ কোন ভাবেই তাকে গাড়ি থেকে নামাতে পারেনি। এমনকি গাড়ির গ্লাস পর্যন্ত খুলতে পারেনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর উত্তরা সাত নম্বর সেক্টরে ২৮ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাসার ২য় তলায় এসএম ন্যাচারাল, ইয়েস ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি ও এসএম ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড হাউজিং লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের নামে চলছে এসব প্রতারণার ব্যবসা। সাজিয়ে রাখা হয়েছে ইলেক্ট্রনিক্সের বিভিন্ন পণ্য, ফ্ল্যাট কেনা-বেচা ও খাদ্যদ্রব্য। এগুলোর ডিলারশিপ দেয়ার নামে চলে প্রতারণা। যা বিক্রির কোনো কাগজ-পত্র দেখাতে পারেননি তারা।  

প্রত্যেকটি অফিস এলাকার পাশের দোকানি ও ওই ভবনগুলোর অন্য ব্যবসায়ীরাও জানান, এরা এমএলএম ব্যবসার নামে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে বলে জানতে পেরেছেন তারা। ভুক্তভোগীদের পুলিশ, সাংবাদিক নিয়ে আসাও দেখেছেন। মাঝে মাঝেই তাদের অফিস বন্ধ থাকে।

এমএলএম ব্যবসার প্রতারণা সম্পর্কে র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, এরা গ্রামের সহজ-সরল মানুষ ও বেকার শিক্ষিত যুবকদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তারা গ্রাহকের থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। এদের বিরুদ্ধে কোনো ভুক্তভোগী সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ নিয়ে এলে অভিযান চালানো হবে।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলী হাসান পলাশ জানান, তারা নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছেন। তবে কাগজ-পত্র দেখতে চাইলে দেখাতে পারেননি তিনি।

উল্টো তিনিই ভুয়া সাংবাদিক বলে প্রচার করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তাকে পুলিশ আনতে বলা হলে তিনি সুর পাল্টে ফেলেন এবং নানাভাবে প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।

জানা গেছে, ২০০২ সালে ডেসটিনিসহ দেশে এমএলএম কোম্পানি ছিল মোট ১৬টি। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টিতে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২ শতাধিক এমএলএম কোম্পানি কাজ করছে। কিন্তু একটি কোম্পানিকেও লাইসেন্স দেয়নি সরকার। অর্থাৎ দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা একেবারেই নিষিদ্ধ।

কিছু কোম্পানি ফুড সাপ্লিমেন্ট, প্রসাধনী সামগ্রী ও হারবাল ওষুধ বিপণনের নামে এমএলএম কার্যক্রম চালাচ্ছে। যদিও ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২-তেও ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, এমএলএম বিতর্কিত পদ্ধতির ব্যবসা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা ধরা পড়ছে। ডেসটিনির প্রতারণা ধরা পড়ার পর বরং উচিত ছিল বাংলাদেশে এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া।

সোনালীনিউজ/এসএ/এমএএইচ