কোটি টাকার প্রকল্পের অর্ধেকই লোপাট

  • লালমনিরহাট ও হাতিবান্ধা প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২১, ১২:২১ পিএম

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে নির্মিত সরকারের ‘দুর্যোগ সহনীয় ইটের ঘর’ অল্প বাতাসেই নড়েচড়ে। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এসব ঘর। অভিযোগ উঠেছে, কোটি টাকার এ প্রকল্পের অর্ধেকটাই লোপাট হয়েছে। উপকারভোগীদের কাছ থেকেও নেওয়া হয়েছে উৎকোচ।

‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের মোড়কে গৃহহীনদের জন্য সরকারের উপহার ‘দুর্যোগ সহনীয় ইটের ঘর’। ২০১৯-২০ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) ও ‘যার জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পের আওতায় লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলায় দুর্যোগ সহনীয় ১২২টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘরের বরাদ্দ দুই লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

নকশা অনুযায়ী, ২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা বরাদ্দের দুই কক্ষের প্রতিটি ঘর তৈরি করার কথা ২০ ফুট লম্বা ও আট ফুট প্রস্থের। চারদিকে ইটের দেয়াল আর উপরে ৪৬ মিলিমিটার রঙিন ঢেউটিন দিয়ে ছাউনি করার কথা। ঘরের ছাউনির কাজে শাল, গর্জন, জারুল, কড়ই, শিশু, তাল, পিতরাজ, দেবদারু বা আকাশমনি কাঠ ব্যবহার করার নির্দেশনা আছে। ঘরের মেঝেতে ইটের সোলিংয়ের উপরে তিন ইঞ্চি সিসি ঢালাই দেওয়ার কথা। রান্নাঘর ও শৌচাগার করার কথা ১৩ ফুট। কিন্তু বাস্তবে এসব নিয়মের অনেকটাই মানা হয়নি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সরকারি এসব ঘর বরাদ্দ নিতে তাদের কাছ থেকে ঘর নির্মাণের জায়গায় মাটি ও বালু ভরাটের কথা বলে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘরের প্লাস্টার ও দরজা-জানালা ভুক্তভোগীরা নিজেরাই লাগিয়ে নিয়েছেন। বেশিরভাগ ঘরের শৌচাগারের কাজও শেষ হয়নি। এই প্রকল্প দেখাশোনা করার জন্য কাগজে-কলমে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের সভাপতি করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই কমিটির কেউই মাঠে ছিলেন না।

নিয়ম রয়েছে, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি পিআইসির মাধ্যমে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে এ ঘরগুলো নির্মাণ করবে। কিন্তু প্রকল্পের নকশা ডিজাইনের তোয়াক্কা না করে গৃহহীন মানুষের টাকা আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে নিজেদের ইচ্ছামতো নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘর নির্মাণে নিম্নমানের ইট, বালু, টিন, কাঠ, বাঁশ ও রড ব্যবহার করা হয়েছে। মানা হয়নি ঘরের নকশা। ওই ঘরে যারা বাস করছে তারা যেমন নাখোশ, তেমনি এলাকার মানুষজন এমন দুর্নীতিকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ২৭৫ বর্গফুটের ঘর নির্মাণে ১ নম্বর ইটের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ২ থেকে ৩ নম্বর ইট। ০.৩৬ এমএমের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ০.৩২ এমএমের ঢেউটিন। নকশায় ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। মেঝে ও পিলারে ব্যবহার করা হয়েছে একেবারেই নিম্নমানের ইটের খোঁয়া। এ কারণে ঘরের মেঝে ও দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। মাত্র তিনটি রডে বানানো হয়েছে পিলার। ছয়টির বদলে জানালা হয়েছে দুটি। ঘরের বেড়া ও চালে ব্যবহার করা হয়েছে কম দামি কাঠ ও বাঁশ। এছাড়া আর বালু, তারকাঁটা, পেরেক, তার, কবজা, ছিটকিনি, স্ক্রু, ওয়াশার, মেঝের রঙের সব কিছুই নেওয়া হয়েছে উপকারভোগীর কাছ থেকে। প্রতিটি ঘরের ভিত দেওয়া হয়েছে খুবই কম। এ কারণে একটু বাতাস হলেই ঘর নড়ে। যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পাড়ে। ঘর নির্মাণের সময় শ্রমিকদের দুপুরের খাবারও খাওয়াতে হয়েছে উপকারভোগীদের। অনেকে আবার মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে এই ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন।

নিম্নমানের ঘর নির্মাণের ব্যাপারে একাধিক সুবিধাভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব নিয়ে কারোর সঙ্গে কথা না বলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাদের।

অভিযোগ উঠেছে, কমিশন লেনদেনের মাধ্যমে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমেদ তার নিজস্ব লোক ও মিস্ত্রি দিয়ে প্রকল্পের প্রতিটি কাজ করেছেন। শুধু তাই নয় টাকার বিনিময় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পছন্দের লোকজনদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারি খাস জমি ও রেলওয়ের খাস জমিতেও অনেককে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফেরদৌস আহমেদ ঘুষ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, নকশা অনুযায়ী ঘর তৈরি করা হয়েছে। অনেক ঘর এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।

এ বিষয়ে হাতীবান্ধা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল আমিন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। ঘর হস্তান্তর করা হলেও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই