বড় বিনিয়োগে বড় বিষণ্নতা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০১৯, ০১:১৩ পিএম

ঢাকা : প্রচলিত খাতে আসছে দেশি-বিদেশি বড় বড় বিনিয়োগ। তবে সেটা বেশ কিছু খাতের উদ্যোক্তাদের বিষণ্নতায় ফেলে দিচ্ছে। কারণ খাতটির অতি উৎপাদনের ঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে নতুন বিনিয়োগের ফলে। ইতোমধ্যে এসব খাতের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ বা তার থেকেও বেশি রয়েছে।

দেশে এমন খাতের মধ্যে রয়েছে ইস্পাত, সিমেন্ট, তেল, চিনি, এলপিজি, স্পিনিংসহ আরো কিছু শিল্প। চাহিদা না থাকায় এসব শিল্পকারখানা এখনই তাদের উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারছে না।  আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক। আর সে সময় বিদেশি বিনিয়োগ আরো উদ্বিগ্ন করছে উদ্যোক্তাদের।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কিছু খাতে অপ্রত্যাশিত বিনিয়োগ আসছে। নানা সুবিধা নিয়ে অভ্যন্তরীণ তৈরি বাজার ধরতে আগ্রহী বিদেশিরাও। যদিও উন্নত দেশে অপ্রচলিত খাতে বেশি বিনিয়োগ হয়। আবার নিজ দেশের ছোট উদ্যোক্তাদের সংরক্ষণের বিষয়ে নজরদারি করা হয়। সরকার এসব বিষয়ে লক্ষ রাখে।

দেশে এখন বছরে ৪৫ লাখ টন ইস্পাতের প্রয়োজন হয়। সেখানে দেশি কোম্পানিগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। এরপরও থেমে নেই এ খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ। দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি এবার এ খাতে বিনিয়োগ করছে বিদেশি দুটি প্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কুনমিং আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশে বছরে আরো ২০ লাখ টন ইস্পাত পণ্য উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে। আর বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের নিপ্পন স্টিল অ্যান্ড সুমিতমো মেটাল বাংলাদেশের ইস্পাত খাতে বিনিয়োগ করছে।

গত সেপ্টেম্বরে নিপ্পনের পরিচালক বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে ১০০ একর জমি ইজারা নেওয়ার চুক্তি করেছেন। যৌথ বিনিয়োগে নিপ্পনের ইস্পাত কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হবে চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে।

এ পরিস্থিতিতে দেশি ইস্পাত শিল্পে স্থবিরতা নেমে আসবে জানিয়ে শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে মাসুদুল আলম মাসুদ বলেন, এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগে দেশের প্রচুর কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ তাদের সঙ্গে আমরা এক অসম প্রতিযোগিতায় পড়ব। এ দুটি কোম্পানিই অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিচ্ছে। ফলে তারা কম খরচে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাবে। অল্প সুদে বিদেশ থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করবে।

এদিকে নির্মাণ শিল্পের আরেক খাত সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা বর্তমানে সাড়ে ৩ কোটি টন। এর বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা ৬ কোটি টনের বেশি। অতি উৎপাদন সক্ষমতার কারণে সম্ভাবনাময় সিমেন্ট খাতে বিপুল বিনিয়োগ থমকে গেছে এর আগেও। সরকারি হিসাবে দেশে ১২৩টি সিমেন্ট কারখানার মধ্যে মাত্র ৩০টিতে উৎপাদন চালু রয়েছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশে দুই সিমেন্ট কারখানায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে সৌদি আরবের কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশনস। সৌদি কোম্পানিটি এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি সিমেন্ট কারখানা করছে। আরেকটি কারখানার আধুনিকায়ন হচ্ছে।

এছাড়াও আরো কিছু দেশ বাংলাদেশে সিমেন্ট কারখানার সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। পাশাপাশি বিদ্যমান উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে আরো নতুন ইউনিট স্থাপন করছে দেশের প্রতিষ্ঠান এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কম্পিটিশনের বিকল্প নেই। যারা একই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসছে, তাদের কৌশল যদি এমন হয় যে তারা এ দেশে প্রতিযোগিতা করে আরো কম খরচে এসব পণ্য সরবরাহ করবে, সেটা সাধারণ মানুষের জন্য ভালো। তবে এতে দেশি উদ্যোক্তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ পরিস্থিতি একটা উভয় সংকট।

নির্মাণশিল্পের দুই খাতের পরে বড় বিনিয়োগের ঝুঁকি চিনি ও তেল পরিশোধন শিল্পে। এ দুই পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ।
এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে সরকারি চিনিকল রয়েছে ১৪টি। এর বাইরে বেসরকারিভাবে চিনি পরিশোধন ও বাজারজাত করছে পাঁচটি কোম্পানি। এসব কোম্পানি এ খাতে ব্যাংকঋণের মাধ্যমে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ নিয়ে এখন শঙ্কায় রয়েছে।

আর দীর্ঘদিন থেকে দেশের সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ৮০ শতাংশ ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কারণ এ তিন কোম্পানি চাহিদার থেকেও বেশি উৎপাদনে সক্ষম।

তবে এ তিন কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণের আগে এমইবি গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ ও নূরজাহান গ্রুপ পরিশোধিত ভোজ্যতেলের ব্যবসায় সক্রিয় ছিল। তবে অর্থনৈতিক কারণে এদের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ।

ভোজ্যতেলের ব্যবসায় এদের ফিরে আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তারপরও গত এক-দেড় বছরে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের ব্যবসায় বসুন্ধরা গ্রুপ, সেনা এডিবল অয়েল, গ্লোব এডিবল অয়েল এবং মজুমদার গ্রুপ বড় বিনিয়োগ করেছে।

শুধু দেশি নয়, এ খাতে বাংলাদেশে যৌথ বিনিয়োগ নিয়ে আসছে ভারত ও সিঙ্গাপুরের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ ও উইলমার গ্রুপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমি ইজারা পেতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে এই দুই কোম্পানি। এ শিল্পনগরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় (৪০ কোটি ডলার) ১১টি কারখানা স্থাপন করা হবে।

এছাড়াও স্পিনিং খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে দেশি উদ্যোক্তাদের। ২৪ লাখ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও এ খাতে উৎপাদন হচ্ছে ১৪ লাখ টনের কিছু বেশি। আর দেশের এলপিজি খাতে চাহিদা তৈরির আগেই অপরিকল্পিতভাবে প্রচুর বিনিয়োগ এ খাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রে যেন একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকে সে জন্য আমরা কাজ করব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই