অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে জনআস্থায় দেশের অর্থনীতি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম

ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের নতুন দায়িত্বে এসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল লুটপাটের শিকার দেশের ব্যাংকিং খাতকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। তবে শুরুতেই দৃশ্যমান সাফল্য দেখিয়েছে এই সরকার। যেখানে দেশের প্রতিটি আর্থিক খাত ছিল ভঙ্গুর, সেই ভঙ্গুরতা কাটিয়ে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যেমন—রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড গঠন এবং খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচনের মাধ্যমে ফিরেছে জনআস্থা।


যেভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারযাত্রা শুরু:

শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্স গঠন: ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠন করা হয় একটি টাস্কফোর্স। এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করে টেকসই সমাধানের পথ তৈরি করা।

ভঙ্গুর রিজার্ভে স্থিতিশীলতা: দেশে অতিমাত্রায় আমদানি ব্যয় ও অর্থপাচারের কারণে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ রিজার্ভ দ্রুত নামতে থাকে। ২০২৪ সালের আগস্টে আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভ দাঁড়ায় মাত্র ২০.৪৭ বিলিয়ন ডলার। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫.০৬ বিলিয়ন ডলারে। সাধারণ হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ৩০.০৮ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "রিজার্ভ থেকে বড় কোনো পরিশোধ করতে হয়নি, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন অতিরিক্ত ডলার কিনে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ করছে।"

ক্রমেই বাড়ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড: ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরই প্রবাসীদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে নতুন সরকারের উদার নীতি ও প্রণোদনার ফলে রেমিট্যান্স ঘুরে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ। এই প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় ২৬.৮ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, "রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের শক্তিশালী প্রবাহ রিজার্ভ পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।"

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ: ২০২৪ সালের আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি যেখানে ছিল ১০.৪৯ শতাংশ, ২০২৫ সালের জুনে তা নেমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৭.৩৯ শতাংশে—যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতি, একাধিকবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি, আমদানির বিধিনিষেধ শিথিল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক হ্রাস—এসব উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, "আমরা মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে কিছুটা সফল হয়েছি। তবে এটা ৩ শতাংশে না নামা পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট নই।"

ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা: ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলেও সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করে। বর্তমানে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দর ১২১.৩৫ থেকে ১২১.৯০ টাকার মধ্যে সীমিত।

গভর্নর জানান, "আমরা বাজারকে রিল্যাক্স করেছিলাম। অনেকে আশঙ্কা করেছিল ডলারের রেট ১৬০–১৭০ ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু সেটা হয়নি।"

খেলাপি ঋণে স্বচ্ছতা: আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখা হতো। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৭ শতাংশ।

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ব্যাংক খাতের দুর্বলতা জনসমক্ষে তুলে ধরেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, ভুয়া জামানত, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ভুয়া ঋণ অনুমোদন এবং নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতাই এই পাহাড়সম ঋণের জন্য দায়ী।


পর্ষদ পুনর্গঠন ১৪টি ব্যাংকের: গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুনভাবে গঠন করেছে।

দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও লুটপাটে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, রিজার্ভ রক্ষা এবং আমদানি-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে নেওয়া সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ইতিবাচক ফল দিতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে কোনো কোনো ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ, মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ সুশাসন ব্যাংক খাতের পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত এক ধরনের নবজাগরণ দেখেছে। রিজার্ভ পুনর্গঠন, ডলার বাজারে নিয়ন্ত্রণ, রেমিট্যান্সে রেকর্ড অর্জন এবং মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি এনে সরকার জনআস্থা অর্জন করতে পেরেছে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, "আমরা রাজনীতি নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতেই কাজ করছি। সামনে আরও সংস্কার অপেক্ষা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই অর্জন যদি ধরে রাখা যায়, তবে আগামী দিনের বাংলাদেশ একটি কার্যকর ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনৈতিক কাঠামো অর্জনে সফল হবে।"

ওএফ