চালের সিন্ডিকেটে নাকাল সরকার

  • শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২৪, ২০১৭, ১০:০৮ এএম

ঢাকা: হঠাৎ করেই চালের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। দাম বাড়ার পেছেন আড়ৎদাররা যুক্তি দেখিয়েছেন চাল নেই। মিল মালিকরা বলছেন, বেশি দামেও ধান পাওয়া যাচেছ না। ফলে চালের সংকটে বেড়েছে দাম। অপরদিকে চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সময়ে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। বাজার পর্যবেক্ষণ করলেই বেরিয়ে আসবে চাল নিয়ন্ত্রণ করছে প্রভাবশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট। তারাই কৃত্রিমভাবে চালের দাম বাড়িয়েছে। যাতে ধান-চাল সংগ্রহ মৌসুমে এবার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে চাল কিনতে বাধ্য হয় সরকার। এর আগে গম কেনার ক্ষেত্রেও এভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে গম কিনতে বাধ্য করেছিল।

কৃষি মন্ত্রণলায়ের হিসাব মতে ২০১৬ সালে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। চালের পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ায় গত বছর ৫০ হাজার মেট্টিক টন সেদ্ধ চাল রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। সাধারণত প্রাকৃতি দুর্যোগ ও নানা প্রয়োজনে সরকারি গুদামে এক বছরের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল মজুদ থাকে। কিন্তু এবছর সরকারের গুদামে গত ১৭ জুলাই পর্যন্ত চাল মজুদ রয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭৭ হাজার টন। যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে বাধ্য হয়ে সরকার অতি দুর্যোগ মোকাবলায় খোলাবাজারে চাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি গুদামে চাল নেই এই তথ্য সিন্ডিকেটকে জানিয়ে দিয়েছে সরকারেরই একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বলে সূত্র জানিয়েছে। এর ফলেই সিন্ডিকেটটি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওই শ্রেণির কর্মকর্তাদের যোগসাজছে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে চালের দাম।

নতুন চাল আসা শুরু করলেও বাজারে মোটা চালের দাম গত দেড় মাসে কেজি প্রতি ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় চালের আড়ৎ বাদামতলী ও বাবুবাজারে বিভিন্ন প্রকারের বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) মোটা চালের দাম বেড়েছে ১ হাজার টাকা ও সরু চালের দাম বস্তা প্রতি বেড়েছে ১১০০ টাকা পর্যন্ত। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি বলছে, মোটা চাল খুচরা পর্যায়ে ৪৬-৪৮ টাকা ও চিকন চাল ৫৮ টাকা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে টিসিবির উল্লেখ করা দরের চেয়েও চার টাকা বেশি কেজি প্রতি।

বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার সমর্থক কয়েকটি সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত মুনাফা করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগ-সাজশ করে বিভিন্ন জায়গায় ধানের মজুদ করেছে তারা। ফলে কৃষকের গোলায় না থাকায় মিলাররা পর্যন্ত ধান পাচ্ছেন না। কৃত্রিম সংকটে ৮০০ টাকা মনের ধান মিলাররা কিনছেন ১১৫০ টাকায়। গতবছরও এ চক্রটি সক্রিয় ছিল।

এবছর সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রয়োজনের অর্ধেকও সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের নির্ধারণ করা দামের চেয়ে বাজারে চালে দাম বেশি। সরকারকেও চালের দাম বাড়াতে হবে। নইলে কেন ‍গুদামে চাল দিতে যাবেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সূত্রি বলছে, সিন্ডিকেটের কাছে ধান ও চাল ঠিকই আছে। কৌশলে সরকারকে বিপদে ফেলে আরো দাম বাড়াতে বাজারে চালের দাম বাড়িয়েছে। গতবারও এই কৌশল নিয়েছিল সিন্ডিকেটটি। পরবর্তীতে সরকারকেও বেশি দামে গম সংগ্রহ করতে হয়েছে। এবারো গতবারের পথে হাঁটছে তারা।

কৃষকদের মুনাফা দিতে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে ধান, চাল ও গম কৃষকদেও কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। আপদকালীন সময়ে সেই চাল ভর্তুকে দিয়ে বা বিনে পয়সায় জনগণের মাঝে বিলিয়ে দেয় সরকার। এজন্য সরাসরি মিল মালিক ও কৃষকদের কাছ থেকে ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু গতবছরের ন্যায় এবারো এই সংগ্রহ অভিযানে এমন লোককেও অনুমোদন দিয়েছে যাদের চাতাল থাকাতো দূরের কথা জীবনে কোনো দিন কৃষি কাজও করেনি। রংপুরের তারাগঞ্জে সরকারি দলের এক ব্যক্তিকে এমন অনুমোদন দেয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। তিনি আগে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন তদ্বির করেই অনেক টাকার মালিক। নিয়ম অনুযায়ী কৃষক ও মিল মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান, চাল সংগ্রহ করার কথা সরকারের। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের নির্ধারিত স্লিপ ছাড়া একটি চালও গুদামে যায় না।

সরকারি পর্যায়ে এবার খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানে ধানের দর নির্ধারণ করেছে ২৪ টাকা, যা গত বার ছিল ২২ টাকা। কেজি প্রতি চালের দর নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা, যা গতবার ছিল ৩১ ও ৩২ টাকা। কিন্তু মিল মালিক ও সরবরাহকারীরা দাবি করেছেন চালের দাম অন্তত ৩৬ টাকা কেজি প্রতি করার। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বাজারের দর চেয়ে বেশি। তাই ৩৪ টাকায় চাল দিলে লস হবে। এজন্য এবারের চাল সংগ্রহ মওসুমেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পরবে না সরকার বলে শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ধানের দাম বেড়েছে। প্রতি হাটে লোক পাঠাচ্ছি বেশি দাম দিলেও ধানের যোগান কম। ৮০০ টাকা মনের ধান এখন ১১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা কেজি প্রতি ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভ করেই চাল ছেড়ে দেই। এখন ধানের দাম বাড়ায় বেশি দামে চাল দিতে হচ্ছে। ধানের দাম কেন বাড়ছে, এর উত্তরে তিনি বলেন, সেটা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার বলতে পারবে।

চালের দাম বাড়ার পিছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকার কথা স্বীকার করেছেন চালকল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী। খাদ্যমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকশেষে সাংবাদিকদের বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াতে পারে। তবে মিলারদের কাছে চালের কোনো মজুদ নেই।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/তালেব