নখদন্তহীন বাংলাদেশ ব্যাংক!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১, ২০১৯, ১২:৫৮ পিএম

ঢাকা : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হচ্ছে সময়ের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির আইনি ক্ষমতা থাকলেও তা প্রয়োগ করতে পারছে না। সরকার ও সরকারের সমর্থক একটি বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশের আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা আরো প্রকট হবে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেশাদার কর্মীরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অবনতির জন্য দায় দিচ্ছেন প্রধান নির্বাহী হিসেবে গভর্নর ফজলে কবিরকে। অবশ্য ফজলে কবির পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কোনোভাবে তার মেয়াদ শেষ করার ক্ষণ গুনছেন। আগামী বছরের মার্চে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, এরই মধ্যে কয়েকবার ফজলে কবির পদত্যাগ করার চিন্তার কথা বিভিন্ন মহলে আলাপ করেছেন। তবে সরকার যাতে বিব্রত না হয় সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি মেয়াদ শেষ করে সম্মান নিয়ে বিদায় নিতে চান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যম সারির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ভাবমূর্তি নিয়ে কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে এর অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। এভাবে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান টিকে থেকে লাভ নেই। আর্থিক খাতে এর তদারকি কমছে। পেশাদার কর্মকর্তারা নিজের উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যাংক পরিদর্শনে গেলেও তারা এক পর্যায়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কারণ তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদন মোতাবেক কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো কর্মকর্তাদের ডেকে শাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেদন উচ্চ পর্যায়ে গিয়ে আর নিচের দিকে নামছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর এমন রাজনৈতিক প্রভাব নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। একে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সরকারের প্রভাব থাকলে কোনো দিন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংকিং খাতে একটি দুষ্টচক্র সক্রিয়। তারা সরকারকে প্রভাবিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জিম্মি করে ফেলেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম ঝিমিয়ে গেছে। এখন কেবল নিয়ম রক্ষার পরিদর্শন পরিচালিত হচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। তারা এখন চিন্তা করছেন, অহেতুক এত পেশাদারি মনোভাব কেন দেখাবেন তারা। বরং পরিদর্শনকালে ব্যাংকগুলো থেকে ফায়দা নিয়ে সম্পদ গড়ার দিকে ঝুঁকছেন অনেক কর্মকর্তা। অনেক কর্মকর্তাই এখন পরিদর্শনে গিয়ে নগদ টাকাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আত্মীয়স্বজনদের চাকরির তদবির করতে শুরু করেছেন।

সূত্র বলছে, পরিস্থিতি অনুধাবন করে গভর্নর পদত্যাগ করার বিষয়টি এরই মধ্যে আলাপ করেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে তিনি পদত্যাগ করলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। দেশে-বিদেশে সরকার সমালোচিত হবে। সেদিক বিবেচনা করে তিনি অনেকটা আপস করে চলছেন। সময় গুনছেন কখন তার মেয়াদ শেষ হবে।

সর্বশেষ পুরোনো ঋণ পরিশোধে বিশেষ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর খসড়া তৈরি হয় একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। জানা যায়, সরকার সংশ্লিষ্ট এবং বেসরকারি ব্যাংকসমূহের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি এটি প্রণয়নে যুক্ত ছিলেন। পরে সেটি পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। যদিও এটি করার একক কর্তৃত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে গভর্নরের উচিত ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানো। তিনি যদি সরকারের সঙ্গে না পারতেন তবে তার নৈতিক জায়গা থেকে সরে যাওয়া উচিত ছিল। এই ঘটনা থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে।    

ব্যাংক মালিকরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। তারা কথা দিয়েছিলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সুদের হার কমেনি। এ কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মার্চ জাতীয় শিল্পমেলা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, সুদের হার কমালেন না কেন?

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব তীব্র রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সার্বিক অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক ভালো না থাকলে অর্থনীতিও ভালো থাকবে না।

ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত এখন খসড়া করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু নির্দেশনা আকারে সেটা জারি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করা, খেলাপি ঋণ হিসাবের নতুন মেয়াদ, সিআরআর কমানো, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন, পরিচালক সংখ্যা বা পরিচালকদের মেয়াদ, প্রধান নির্বাহীদের নিয়োগ ও শাস্তি এমনকি প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা পর্যবেক্ষক পর্যন্ত ফেরত আনা হচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব ঘটনার ফলে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে গিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরির সুযোগ পাওয়ার আশায় নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে দুর্বল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আবার বড় গ্রুপের ঋণ অনিয়ম বা বেনামি ঋণ ধরতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সেখানে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ জানায় সংস্থাটি। এর মধ্যে নির্দেশিত ঋণ, নিম্ন মানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দুর্বল করপোরেট সুশাসনের কথা উল্লেখ করা হয়।

ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের অভ্যাস এবং ঋণ অবলোপন করার প্রবণতা বেড়েছে, যা ব্যাংক খাতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার তাগিদ দেয় বিশ্বব্যাংক।

সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমিত স্বাধীনতা এবং আইনবিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের অভাবে ব্যাংক খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি হচ্ছে না।

ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সরকার। সংশোধিত আইনের আলোকে এক পরিবার থেকে চারজন এবং পরিচালক পদে টানা নয় বছর থাকার সুযোগ দেওয়া হয়।

এই সংশোধনীর বিপক্ষে মত দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বলেছিল, এমনটি হলে পরিচালকদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুরূহ হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারা পাঁচবার সংশোধন করা হয়।

সর্বশেষ ২০১৩ সালে সংশোধিত আইনে দুই মেয়াদে ছয় বছর পরিচালক থাকার বিধান যুক্ত করা হয়। এভাবে প্রভাবশালীরা চাইলেই যেকোনো কিছু পেয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতামত পাশ কাটিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দুর্বল হচ্ছে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক বলেন, যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর দরকার হবে না। আস্তে আস্তে এটি একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পাবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই