শিক্ষাঙ্গনের নজিরবিহীন সব সিদ্ধান্ত

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২০, ০৪:০৫ পিএম

ঢাকা : বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী যত সেক্টর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার মধ্যে শিক্ষাঙ্গনই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ। বছরের আড়াই মাস যেতেই শিক্ষাঙ্গনে শুরু হয় যুদ্ধকালীন অবস্থা! যা আজও বিদ্যমান। কবে শেষ হবে এ অবস্থা জানা নেই কারও।

স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে এখন ঘরবন্দি শিক্ষার্থীরা। টেলিভিশন, মোবাইলে অনলাইনে পাঠ চুকিয়ে শিক্ষাবছর গেলো চার কোটি শিক্ষার্থীর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে না পেরে ঘরবন্দি অবস্থায় পরীক্ষাবিহীন বছরও পার করেছে শিক্ষার্থীরা, শ্রেণি পরীক্ষার পাশাপাশি বড় পাবলিক পরীক্ষাও হয়নি করোনা মহামারির বছর। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি : গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। দফায় দফায় বাড়ানো হয় এই ছুটি। সবশেষ দফা বাড়িয়ে আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি।

‘আমার ঘরে আমার ক্লাস’ ও ‘ঘরে বসে শিখি’ শিরোনামেই চলছে শিক্ষা

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে গত ২৯ মার্চ থেকে সংসদ টিভিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস দেখানো শুরু করে সরকার। টিভির এই ক্লাস দেখে শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ করে স্কুল খোলার পর তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে জমা দিতে বলা হয়। বাড়ির কাজের উপর প্রাপ্ত নম্বর শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে জানানো হয়েছিল।

‘আমার ঘরে আমার ক্লাস’ শিরোনামে জাতীয় সংগীত ও করোনা সচেতনতা দিয়ে সকাল ৯টায় সংসদ টিভিতে ক্লাস শুরু হয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আটটি বিষয়ের ক্লাস হয়। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ওইসব ক্লাস পুনঃপ্রচার করা হয়। এ কার্যক্রম চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত।

মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পর প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টিভিতে ৭ এপ্রিল থেকে ‘ঘরে বসে শিখি’ শিরোনামে ক্লাস শুরু হয়। পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে সংসদ টিভির পাশাপাশি বেতারের মাধ্যমে প্রাথমিকের ক্লাস সম্প্রচার শুরু হয় ১২ অগাস্ট। বাংলাদেশ বেতারের এএম-৬৯৩ মেগাহার্টজে এবং এফএম ব্র্যান্ড ও কমিউনিটি রেডিওতে এই ক্লাসের সম্প্রচার শুরু করে। ইউনেস্কোর সহযোগিতায় দূর শিক্ষণ পদ্ধতিতে বেতারে ‘ঘরে বসে শিখি’ স্লোগানে ক্লাস সম্প্রচার করা হয়েছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পর ১২ এপ্রিল তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেশের সব কলেজের অধ্যক্ষদের নির্দেশনা দেয় সরকার। এরপর উচ্চ শিক্ষা স্তরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস চালুর উদ্যোগ নেয়। অনলাইনে ক্লাস নিতে স্মার্টফোন কিনতে ঋণ বিতরণের উদ্যোগও নিয়েছে ইউজিসি।
 
বাতিল সব পরীক্ষা : মহামারির কারণে এবছর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী, অষ্টমের সমাপনী ছাড়াও এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষার বদলে নিজ প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়নের সনদ দেওয়া হবে।

এদিকে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে অন্যান্য শ্রেণিগুলোয় পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী ক্লাসে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় অনার্স ও মাস্টার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইউজিসি। আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

বদলে গেল ভর্তিতে আগের নিয়ম : দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর শুধু প্রথম শ্রেণিতে অনলাইনে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও এবছর প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারিতে ভর্তি করা হবে। পরীক্ষা না নিয়ে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর অনলাইনে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে।

অপরদিকে, শিক্ষামন্ত্রী এবং ইউজিসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সমন্বয়ের গঠিত কমিটির প্রথম সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিত করে দেয়া হবে নতুন বই : স্কুল বন্ধ রেখেই শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিত করে এবার নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল থেকে বই নিতে হবে। স্কুলে আগে থেকেই বই প্যাকেট করা থাকবে। শিক্ষার্থীরা শুধু সংগ্রহ করবে। কোন দিন কোন ক্লাসের বই দেয়া হবে তা আগে থেকেই স্কুলের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া হবে।

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে : সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে আবেদনের তিন মাস পর নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। তবে নানা জটিলতায় চলতি অর্থবছরে (জুনের মধ্যে) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিকে সংস্কৃতি চর্চায় নীতিমালা করছে সরকার : জাতীয় সংস্কৃতি নীতি সংশোধনের উদ্যোগের পর দেশের অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতি পাওয়া সব ধরনের মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চার সুনির্দিষ্ট কাঠামো দাঁড় করাতে নীতিমালা করছে সরকার।

গত ১৫ ডিসেম্বর ‘মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম পরিচালনা নীতিমালা, ২০২০’ খসড়াটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। খসড়া নীতিমালায় অংশীজনসহ সংশ্লিষ্টদের আগামী ১৭ জানুয়ারির মধ্যে মতামত দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

শিক্ষা খাতের সিন্ডিকেট এবং বদলি : শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেটের সদস্যদের বহাল তবিয়তে থাকার ঘটনায় অসন্তোষ আছে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এছাড়া শিক্ষাভবনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সেবা কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা এবং ভোগান্তির ঘটনায় ক্ষুব্ধ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা।

বিপরীত দিকে নীতিমালা তৈরির নামে ঝুলে আছে সাধারণ (শিক্ষক) কর্মকর্তাদের বদলি কার্যক্রম। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনে বই কেনা কার্যক্রমে উদ্ভূত বিতর্ক এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের অবৈধ সনদের বৈধতা দেয়ার বিষয়টিও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে।

বিদায়ী বছরেও বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষকরা রাজপথে ছিলেন। বিশেষ করে ইবতেদায়ি শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করেন। করোনার কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কেজি স্কুলগুলো বন্ধের পথে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর খোলা সম্ভব না-ও হতে পারে।

কেজি স্কুলগুলো বন্ধের পথে : দায়ী বছরেও বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষকরা রাজপথে ছিলেন। বিশেষ করে ইবতেদায়ি শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করেন। করোনার কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে কেজি স্কুলগুলো বন্ধের পথে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর খোলা সম্ভব না-ও হতে পারে।

কারিগরি শিক্ষা : সরকার কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এই শিক্ষার উন্নয়নে নিয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। আলোচ্য বছরে ২১ হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। অপরদিকে স্টেপ নামে একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। ওই প্রকল্পে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু কমিটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। অভিযুক্তরা শাস্তির বদলে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেয়েছেন।

এ বছরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিতে বয়সের সীমা তুলে দিয়ে নতুন নীতিমালা করা হয়। তবে প্রত্যাশিত পর্যায়ে ভর্তির হার বাড়েনি। অপরদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রমে গতিশীলতা ব্যাপক হারে কমেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ আর সেমিনারের সম্মানীর নামে লাখ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ার অভিযোগ আছে।

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে হিফজ মাদ্রাসা খোলার অনুমতি : দেশের সব হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও হিফজখানা ১২ জুলাই থেকে চালুর অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে এসব মাদ্রাসাকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের আবেদনের ভিত্তিতে এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

হাফিজিয়া মাদ্রাসা এবং হিফজখানার শিক্ষা কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাবসায়ের আবশ্যকতার কথা উল্লেখ করে এর কার্যক্রম চালু করার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের পক্ষ হতে আবেদন করা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে আবেদনের বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করে শুধুমাত্র হাফিজিয়া মাদ্রাসা/হিফজখানার কার্যক্রম আগামী ১২ জুলাই থেকে চালু করার অনুমতি প্রদান করা হল।

৬ শর্তে কওমি মাদ্রাসা খোলার অনুমতি: দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা না দিলেও কওমি মাদ্রাসা খোলার অনুমতি দিয়েছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে। তবে ৬টি শর্ত পালন করতে হবে মাদ্রাসাগুলোকে। 

শর্তগুলো হলো:

১. প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, মাথায় নিরাপত্তা টুপি পরা আবশ্যক।
২. মাদ্রাসায় প্রবেশের পূর্বে গেটে স্যানিটাইজিং করতে হবে।
৩. শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করবে, বিক্ষিপ্তভাবে চলাফেরা করবে না।
৪. একজন শিক্ষার্থী অন্য শিক্ষার্থী থেকে কমপক্ষে ৩ ফিট দূরত্বে অবস্থান করবে।
৫. করোনার কারণে কোলাকুলি ও হাত মেলানো যাবে না।
৬. শিক্ষক ও কর্মচারীরাও একইভাবে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ক্লাস করাবেন।

সোনালীনিউজ/এইচএন/এমটিআই