মামলার জালে শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমে স্থবিরতা

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২১, ১২:৩৯ পিএম

ঢাকা : গভর্নিং বডির কাছ থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগদানের ক্ষমতা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকেই হযরবরল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্থাটির সিদ্ধান্তহীনতায় একের পর এক মামলার জালে পড়তে হচ্ছে। এ কারণে আটকে যাচ্ছে একের পর এক নিয়োগ প্রক্রিয়া। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মেধাতালিকায় থাকা ৫ লাখ প্রার্থী।

২০০৫ সাল থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য সনদ দিত এনটিআরসিএ। এই সনদ থাকলেও নিয়োগের ক্ষমতা ছিল গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির হাতে। ২০১৫ সালে এই পদ্ধতির পরিবর্তন আনে সরকার। ১২তম নিবন্ধন পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে মেধা তালিকা করা হয় উপজেলাভিত্তিক। শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার আগে পাশ হয় নতুন আইনও।

কিন্তু এনটিআরসিএর হাতে নিয়োগের ক্ষমতা গেলেও তালগোল পাকিয়ে ফেলে সংস্থাটি। একের পর এক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ হন প্রার্থীরা। এ কারণে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের হয়। মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার শতাধিক। মামলার কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিতেও পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষকশূন্যতায় ভুগছে।

সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের বিপরীতে এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে প্রার্থীদের প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক ও জাতীয় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পেতে হয়। এরপর নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি বা সার্কুলারের মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হয়। চূড়ান্ত ধাপে মেধা তালিকা অনুসরণ করে প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে একজন শিক্ষককে উক্ত পদে সুপারিশ করা হয়।

এনটিআরসিএ প্রথম থেকে ১৪তম সমন্বিত মেধা তালিকা থেকে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রায় ৪০ হাজার পদে নিয়োগ দেয়। নিয়োগের পর একাধিক মামলা হয়। আদালতের রায়ে প্রথম থেকে ১৫তম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে একটি সম্মিলিত মেধা তালিকা তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রেও গরমিলের অভিযোগ করেন প্রার্থীরা। এমনকি সন্দেহের বশেও তারা উচ্চ আদালতে রিট মামলা করেন।

প্রার্থী কমানোর জন্য প্রথম থেকে তৃতীয়, প্রথম থেকে ষষ্ঠ বা প্রথম থেকে অষ্টম নিবন্ধন পর্যন্ত বাদ দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে। এসব কারণে চার শতাধিক রিট মামলা করেন প্রার্থীরা, যেগুলো নিষ্পত্তি করতে হচ্ছে। এছাড়া এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য এনটিআরসিএর কর্মকর্তাদের উদাসীন ভাব রয়েছে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

শিক্ষক নিয়োগের দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির কাজ শেষ হওয়ার আড়াই বছর পর প্রতিষ্ঠানটি গত ৩০ এপ্রিল ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং ৩ মে পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করে। ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে শিক্ষকদের সুপারিশ করতে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করবে এমনই কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা করতে পারেনি। তারা বিভিন্ন মামলাসংক্রান্ত কারণে কালক্ষেপণ করে। প্রার্থীরা বলছেন, এই মামলাসংক্রান্ত জটিলতা তাদের অনেক পুরোনো।

তাছাড়া তাদের কিছু হুটহাট সিদ্ধান্ত ও মামলাগুলোকে অবহেলা করার জন্যই এই অবস্থার সৃষ্টি। আপিল ডিভিশনের চূড়ান্ত রায় পাওয়ার পর এখন আবার রায়ের কপির অজুহাত দিচ্ছে। এ রকম বক্তব্য তাদের কাছ থেকে বহুবার পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করা যেন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠানটির সচিব ড. এ টি এম মাহবুব-উল করিম সোমবার (৫ জুলাই) বলেন, তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে আদালতের সার্টিফিক কপি পাওয়ার পরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এক নিয়োগের আবেদনে দুবার ফি : শিক্ষক হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে স্কুল বা কলেজ ক্যাটগিরিতে প্রার্থীরা আবেদন করেন। একটি আবেদনের খরচ ৩৫০ টাকা।

আবার শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হওয়ার পর, অর্থাত্ জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান করে নেওয়ার পর আবার নিয়োগের জন্য নতুন করে আবেদন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন ফি ১০০ টাকা । এক্ষেত্রে একজন চাকরিপ্রার্থী তার বিষয়ে সারা দেশে যতগুলো শূন্যপদ থাকবে, সবগুলোতে আবেদন করতে পারবেন।

প্রার্থীদের অভিযোগ, একটি পদে চাকরি নিশ্চিত করার জন্য শূন্যপদভেদে সারা দেশে ২৫০ থেকে ৩০০ পদে আবেদন করতে হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অনেক প্রার্থীকে দেখা যায় ৫০-৬০ হাজার টাকারও আবেদন করেন, যা নিবন্ধনধারীদের জন্য অনেক কষ্টের। তাছাড়া সব চাকরিতে একবারই আবেদন ফি নেওয়া হয়। তাদের প্রশ্ন, তবে এনটিআরসিএতে ব্যতিক্রম কেন?

প্রার্থীদের অর্থে স্বাবলম্বী এনটিআরসিএ : প্রার্থীদের অর্থে স্বাবলম্বী এনটিআরসিএর উচ্ছ্বসিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতিষ্ঠানটি গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির নিয়োগ সম্পন্ন করার পর দীর্ঘ এই আড়াই বছরে আর কোনো নিয়োগ দিতে পারেনি। ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন আবেদনকারী ছিলেন ৮ লাখ ৭৬ হাজার। ৩৫০ টাকা ফি বাবদ আদায় হয়েছে ৩১ কোটি টাকা।

১৬তম আবেদনকারী ছিলেন ১১ লাখ ৭৬ হাজার, আবেদন ফি বাবদ আদায় ৪১ কোটি টাকা। ১৭তম নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদনকারী ছিলেন ১১ লাখ ৬৫ হাজার, আদায় হয়েছে ৪১ কোটি এবং তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য আবেদন পড়েছে ৯০ লাখ। ১১০ টাকা ফি বাবদ প্রায় ৯০ কোটি টাকারও বেশি। অথচ এই আড়াই বছরে নতুন করে এক জনেরও নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

দুই বছরে পাঁচ চেয়ারম্যান বদলি : এনটিআরসিতে এই অচলাবস্থার পেছনে বারবার চেয়ারম্যান বদলকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ। গত আড়াই বছরে আট জন চেয়ারম্যান বদল হয়েছেন।

এছাড়া নিয়োগ পাওয়ার পরও একজন চেয়ারম্যান এখানে যোগদান করেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি মূলত চেয়ারম্যাননির্ভর। চেয়ারম্যান দীর্ঘ সময় না থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ছিল।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম ঝামেলা মনে করে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে থাকতে চান না কেউ কেউ। সূত্র : ইত্তেফাক

সোনালীনিউজ/এমটিআই