এমপিও পাওয়া নিয়ে ধোঁয়াশায় যেসব প্রতিষ্ঠান

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৯, ২০২১, ০২:২০ পিএম

ঢাকা : চলতি মাসের শেষে অথবা আগামী জানুয়ারির প্রথম দিকে এমপিওভুক্তির অনলাইন আবেদন কার্যক্রম শুরু হতে পারে। চলতি শিক্ষাবর্ষে সরকার এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) উদ্যোগ নিলেও কঠিন নীতিমালার ‘গ্যাঁড়াকলে’ পড়ে বহুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবেদনই করতে পারবে না। এর ফলে ঠিক কতসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের এই সুবিধা পাবে তা নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। এতে ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা হতাশার কথা জানিয়েছেন।

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, নিম্ন মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায় ও স্কুল এন্ড কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্তিতে শর্তের কঠোরতা কিছুটা কম রয়েছে। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজ ও ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজের ক্ষেত্রে এমপিও শর্তের কঠোরতা বেশি থাকায় এই স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি কম হবে। এর ফলে বহু ননএমপিও কলেজ চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই মুহূর্তে সারাদেশের ছয় হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার প্রতিষ্ঠান নতুন। বাকিগুলো স্তর পরিবর্তনের এমপিওর জন্য আবেদনের অপেক্ষায়। নিম্নমাধ্যমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত, মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত এবং উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হওয়াকে শিক্ষা প্রশাসনে ‘স্তর পরিবর্তন’ বলা হয়।

আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে। অনলাইনে দাখিল করা আবেদন এবার অনলাইনেই মূল্যায়ন করা হবে। এরপর গ্রেডিং করা হবে। সবশেষে সর্বোচ্চ গ্রেডপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্তি দেয়ার জন্য চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেয়া হবে।

এর আগে গত মার্চে ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০২১’ চূড়ান্ত করা হয়। নতুন নীতিমালায় এমপিওর শর্ত ‘কঠিন’ করায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পড়েছেন অন্তত ৯০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, আমরা নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজ শুরু করেছি। শিক্ষকদের আমি আশ্বস্ত করতে চাই, সব ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওর আওতায় আনা হবে।

তবে ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি ও খুলনা আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ গোলাম মাহদুন্নবী ডলার বলেন, চলতি বছরের এমপিওভুক্তির যে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে তা অন্যবারের চেয়ে কঠোর। চূড়ান্ত হওয়ার আগে যেসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তা ওই নীতিমালায় রাখা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, মানবিক বিবেচনায় শর্ত শিথিল না করলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বহু কলেজ এমপিও পাবে না। এমনকি এমপিওর জন্য বহু কলেজ আবেদনই করতে পারবে না। তবে স্কুল এবং স্কুল এন্ড কলেজের ক্ষেত্রে শর্তের কঠোরতা কম থাকায় এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান কিছুটা লাভবান হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, সর্বশেষ দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দীর্ঘ ৯ বছর পর ২৭৩০টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছিল সরকার। সেবার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি) ৪৩৯টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি) ১০৮টি।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণি স্তরের প্রতিষ্ঠান ৮৮৭টি, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬৮টি, কলেজ (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) ৯৩টি এবং ডিগ্রি কলেজ ৫৬টি এমপিওভুক্ত করা হয়। এছাড়া মাদ্রাসা ছিল ৫৫৭টি। এর আগে ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এমপিওভুক্তির দাবিতে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলন করেছেন।

এমপিওভুক্তি পেতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রেডিংয়ের বিধান রাখা হয়েছে এবার। তিন ক্যাটাগরিতে মোট ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে এ গ্রেডিং হবে। সেগুলো হলো- শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারে ৪০ নম্বর। এসব শর্ত পূরণ করতে পারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে। তবে এ নীতিমালার ২২ ধারায় বিশেষ ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের বিধানও রাখা হয়েছে।

এ ধারায় বলা হয়েছে- শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি এলাকা, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, ছিটমহল, বস্তি এলাকা, নারীশিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসরগোষ্ঠী যেমন- প্রতিবন্ধী, হরিজন, সেবক, চা-বাগান শ্রমিক, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, চারুকলা, বিকেএসপি, সংস্থা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় শর্ত শিথিলযোগ্য।

নতুন নীতিমালায় সবচেয়ে কঠিন হয়েছে কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়া। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ক্ষেত্রে আগে তিন গ্রুপ (বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও মানবিক) মিলে ৬০ জন শিক্ষার্থী থাকলেই হতো। নতুন নীতিমালায় শর্তজুড়ে দেয়া হয়েছে প্রতিটি গ্রুপে আলাদা আলাদা ৬০ জন করে মোট ১৮০ জন ছাত্রছাত্রী থাকতে হবে। এই শর্তের কারণে গ্রামগঞ্জের বহু কলেজ আর এমপিওভুক্ত হতে পারবে না।

নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ-অষ্টম) বিদ্যালয় এমপিওভুক্তি পেতে শহর ও মফস্বলের ন্যূনতম ছাত্রছাত্রী থাকতে হবে যথাক্রমে ১২০ জন ও ৯০ জন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (ষষ্ঠ-দশম) ক্ষেত্রে শহর ও মফস্বলে এ সংখ্যা যথাক্রমে ২০০ জন ও ১৫০ জন। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ) তা ৪২০ জন ও ৩২০ জন। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে (একাদশ ও দ্বাদশ ন্যূনতম ছাত্রছাত্রী থাকতে হবে শহরে ১৮০ জন, মফস্বলে ১৪০ জন। স্নাতক (পাস) কলেজে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৯০ জন ও ৪২৫ জন (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখাসহ)।

একইভাবে এমপিওভুক্তি পেতে পাসের হারের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হার নির্ধারণ করা হয়েছে এবার। জেএসসিতে শহর, জেলা সদর/পৌরসভা এবং মফস্বল এই তিন ক্যাটাগরিতে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাসের ন্যূনতম হার হতে হবে যথাক্রমে ৭০, ৬৫ ও ৬০ শতাংশ। এসএসসিতে তা ৭০, ৬০ ও ৫৫ শতাংশ। এইচএসসিতে শহরে ৬৫, জেলা সদর ও পৌরসভায় ৫৫ ও মফস্বলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পাস করতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে সরকার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। প্রতিটি এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজের পেছনে বছরে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৬৯ লাখ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ৬৯ লাখ টাকা, আর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাগে প্রায় ১৬ লাখ টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৮ হাজার ৯১০টি। এর মধ্যে স্কুল ১৮ হাজার ১৯৭টি, কলেজ ২ হাজার ৩৬৫টি, মাদ্রাসা ৭ হাজার ৬১৮টি। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ সরকার প্রতি মাসে ৯৪১ কোটি টাকা ব্যয় করছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই