জঙ্গি হুমকির তালিকায় রাবির ১২ শিক্ষককে বিশেষ নিরাপত্তা

  • রাবি প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০১৮, ০৫:৩৮ পিএম

রাবি: জঙ্গি হুমকির কথা মাথায় রেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বর্তমান ও প্রাক্তন ১২ শিক্ষককে বিশেষভাবে নিরাপত্তা দিচ্ছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি)। তাদের জন্য পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকছেন। তবে এতে করে নিরাপত্তার থেকে উল্টো হুমকিতে পড়ছেন বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। অনেক ক্ষেত্রে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশও।   

আরএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলছেন, নিরাপত্তা পাওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে তাদের কাছে বিভিন্ন হুমকির তথ্য আছে। তাই ওই শিক্ষকদের বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে।

বিশেষ নিরাপত্তা পাওয়া ১২ শিক্ষক হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম, সহকারী অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ হাসান ইমাম, অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এসএম আবুবকর, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সরকার সুজিত কুমার, সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক সাদেকুল আরেফিন মাতিন, আইন বিভাগের অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন এবং ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক আমিরুল ইসলাম কনক।     

ওই শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক ও অধ্যাপক মুহাম্মদ হাসান ইমাম বাড়ির বাইরে গেলে তাদের নিরাপত্তায় পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন থাকছে। ক্যাম্পাসে অবস্থানের সময়ও হাসান ইমামের জন্য পুলিশ পাহারায় রাখা হচ্ছে। এছাড়া বাকি শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন এবং খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাদের কেউ চাইলে সব ধরণের নিরাপত্তা দেয়ার কথাও ভাবছে পুলিশ।     

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৩ মার্চ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর প্রকাশ্যে হামলার পর তারা বেশি তৎপর হয়েছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন সময় হুমকি পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকদের তারা বাড়তি নিরাপত্তা দিতে চাইছে। তাই প্রতিদিন নতুন নতুন শিক্ষকদের নামের তালিকা করে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। বুধবার (২১ মার্চ) থেকে নতুন করে আরেক শিক্ষককে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করছে তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশেষ নিরাপত্তা পাওয়া এসব শিক্ষকদের অনেককেই ২০১৫ সাল থেকে নানাভাবে ‘লাল বাহিনী’, ‘চরমপন্থী গ্রুপের নেতা’, ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ ও ‘জনযুদ্ধের কমান্ডার মেজর জিয়া’-এসব পরিচয়ে হুমকি দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আরও অন্তত ৩০ শিক্ষককে বিভিন্ন সময় প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নগরীর মতিহার থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার কোনো নজির চোখে পড়েনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, ‘এটা কোনো ভালো পদ্ধতি না। সম্ভাব্য কাদের ওপরে হামলা হবে তার তালিকা পুলিশ তৈরি করে মানে কী! এটাতে তখন বিপন্নতা বাড়ে, নিরাপত্তা বাড়ে না। পুলিশ যদি কারও নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত হয় তাহলে তো পুলিশ পুলিশের মতো করে কাজ করবে। মানুষকে গিয়ে বারবার বলার কী আছে? আর সেই মানুষটাকেই নজরদারি করার কী আছে? এগুলো পুলিশ কোথা থেকে তথ্য পায়, আমি তো বুঝতে পারি না।’  

সেলিম রেজা নিউটন আরও বলেন, ‘এটাতে উল্টো আমি নজরদারির মধ্যে আছি বলে ফিল (অনুভব) করছি। আমি কোথায় যাব তাদের ফোন করে যেতে হবে। এটাতে তো আমার সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) বাড়ে না। মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গেও তো গানম্যান (বন্দুকধারী) ছিলেন সার্বক্ষণিকভাবে। তিনি ওখানে আক্রান্ত হলেন। তাই রাষ্ট্র যদি সমাজের সার্বিকভাবে নিরাপত্তার ব্যাপারটা বাড়াতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার দিকে যেতে হবে। এভাবে পুলিশ দিয়ে কোনো নিরাপত্তা হয় না। এভাবে রাষ্ট্রই টার্গেট করছে নেক্সট লিস্টে (পরের তালিকায়) এরা আছে। এটাতে জঙ্গিদের পরোক্ষভাবে মেসেজ দেয়া হয় যে, তোমাদের পরবর্তী তালিকা এরকম হতে পারে। আলাদাভাবে কাউকে নিরাপত্তা না দিয়ে গোটা সোসাইটির (সমাজের) নিরাপত্তা দেয়া দরকার।’     

বিশেষ নিরাপত্তা পাওয়া আরেক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে  বলেন, ‘এখন নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আছি আরকি। আমার নিরাপত্তায় পুলিশ থাকতে চাইলে আমি রাখিনি। অন্য কেউ রেখেছেন কি না সেটা আমি জানি না।’ আরেকজন অধ্যাপক বলেন, ‘এভাবে নিরাপত্তা দিয়ে কতটা কাজ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। জাফর ইকবালকে হামলার সময় তার পাশেই দুজন পুলিশ ছিল। কিন্তু তাতেও হামলা থেকে তাকে রক্ষা করা যায়নি। সমাজের এই শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে না পারলে সেই হুমকি থেকেই যাবে। তাই সেই হুমকিদাতাদের নিশ্চিহ্ন করতে কাজ করতে হবে।’  

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, জাফর ইকবালের ওপর হামলার পর পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়তি নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আমাদের থেকে শিক্ষকদের একটি তালিকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটি আর নেয়নি পুলিশ। এখন তারা নিজেরা তালিকা করে হয়তো নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা অন্য সময়ের থেকে এখন অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রশাসন সামগ্রিকভাবে তৎপর আছে বলেও জানান তিনি।  

এ বিষয়ে আরএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান  বলেন, ‘কয়েকজনকে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। কেননা তাদের জন্য থ্রেট (হুমকি) আছে, আমরা মনে করছি যে, তাদের সতর্কভাবে চলা উচিত। তারা বাইরে যখন যাচ্ছেন আমাদের জানাচ্ছেন, আমরা জাস্ট ফলো করছি।’

সোনালীনিউজ/এমএইচমএম