জবিতে শিক্ষকের যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রীর আর্তনাদ!

  • জাবি প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০১৮, ০৪:৩২ পিএম

জবি : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক আবদুল হালিম প্রামাণিকের যৌন নিপিড়নের শিকার ওই বিভাগের এক ছাত্রীর আর্তনাদ।

আমি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা সামান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকের সন্তান ছিলাম বলেই হয়তো পড়াশোনার কোনো কমতি ছিল না জীবনে। বিলাশবহুল জীবনযাপন করতে না পারলেও খাতাপত্রের অভাববোধ কোনোদিন হয়নি। বাবার খুব স্বপ্ন ছিল ঢাকাতে পড়াশোনা করব। বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইউনিটে লিখিত পরীক্ষায় আমার মেরিট লিস্ট ৯১ সিরিয়াল এসেছিল। নাট্যকলায় প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা দেওয়ার পর ১৩তম হয়ে ভর্তি হই নাট্যকলা বিভাগে। ক্লাস শুরু হলো চলছিল বেশ। নতুন শহর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সব মিলে মনে হচ্ছিলো জীবনটা সুন্দর।

কিন্তু সুন্দর জিনিস সবসময় সুন্দর থাকে না। ১ম বর্ষ ১ম সেমিস্টারে অভিনয় প্রস্তুতি-১১০৫ নামে একটা কোর্স ছিল। কোর্স শিক্ষক আবদুল হালিম প্রমানিক স্যার। স্যারকে ভালোই লাগতো একেতো উত্তরবঙ্গের মানুষ তার ওপর মাথায় হাত দিয়ে আমাকে মা মা করে ডাকত। জীবনে কখনো থিয়েটার, নাটক করিনি। ইম্পোভাইজেশন কিছুই পারতাম না। অভিনয় করতে হলে শরীর ফিট থাকতে হয়, কিন্তু স্যার বলতো আপনার ঘার শক্ত, বাকা। আমি খুব চেষ্টা করতাম ঠিক করার জন্য। তো স্যার সবাইকে ধরে ধরেই দেখাতো। আমার যেহেতু হয় না আমাকে বেশি ধরে দেখাতো। আমার একটু অস্বস্তি লাগতো কিন্তু যখন দেখতাম সবাইকে তো ধরছে সমস্যা নাই। নাট্যকলায় হয়ত এমনি হয়।

তারপর অনেকক্ষণ বিভিন্ন বেয়াম করানোর পর স্যার আমাদের বলতেন সবাই মেঝেতে শুয়ে পরে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন আপনার মাথার ওপর একটা কালো বল ঘুরছে। যেহেতু আমরা অনেক ক্লান্ত থাকতাম তাই সবাই আরামে চোখ বন্ধ করে থাকতাম। কেউ কেউ তো ঘুমিয়ে পরত। হঠাৎ একদিন অনুভব করলাম স্যার আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়ে আছে। আমার কানে কানে বলছে আপনার সব টেনশন ঘারে। ঘাড়টা ঠিক করেন। স্যার তখন নিজেই ঘারে হাত দিয়ে ম্যাসাজ করতেন। আমার খুব অসস্তি লাগতো কিন্তু করার কিছু ছিল না। যেহেতু আমার হচ্ছে না স্যার নিজে থেকে আমাকে সাহায্য করছে আমার ভালোর জন্যই তো। সেদিন মেসে এসে খুব কান্নাকাটি করছি। তারপর ওই ক্লাস যেদিন যেদিন থাকে ভয়ে আমার অস্থির লাগা শুরু করল। কারণ এ রকম আরও দুই তিনদিন স্যার আমার কাধে হাত দিল এবং ইদানিং তার হাতটি কাধ ছেড়ে অনেক নিচে নেমে এসেছে। একদিন সে একিভাবে আমার কমরে পেটে হাত রাখলো সেদিন আর চুপ করে থাকিনি।

স্যারের হাত ঝাটকা মেরে সরাই দিয়ে অসুস্থ লাগছে বলে বাথরুমে গিয়ে অনেক কাঁদছি। তারপর টানা দুইদিন আমি তার ক্লাস করিনি। একদিন তিনি আমাদের ভাইবা নেবে বলে একজন একজন করে ডাকছিল। আমার সিরিয়াল যখন আসল তখন আমি সোজা রুমে ঢুকেছি আর স্যারকে বলেছি স্যার আপনি কেন আমার সঙ্গে এমন করছেন? এরপর আমি কিন্তু এ কথাটি আমার বন্ধুদের বলে দিব। তিনি আবারও আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন ললিতা মা আপনাদের সঙ্গে এই কোর্সটি আমার শেষ। যদিও তিনি আমাকে মুখে কিছু বলেননি, কিন্তু চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন-যদি মুখ খুলিস তো তোর অস্তিত্ব বিলীন করে দিব আমি। একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যায় তখন এটা আমি জানতামই না। আর সব থেকে বড় কথা তখনো আমার কোনো ভালো বন্ধু হয়ে উঠেনি তাই কার সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করব সেটাও বুঝতে পারছিলাম না।

এভাবেই ভয়, অনিশ্চয়তা, লজ্জা, অস্তিত্বহীনতায় ১ম এবং ২য় সেমিস্টার পরীক্ষা দিলাম। এসবের মাঝেও রেজাল্ট কিন্তু আমার খারাপ হয়নি। ৩.৪৭ বাসার সবাই অনেক খুশি। আমিও বোধহয় ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছিলাম সবকিছু। কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় আমার পরের ব্যাচের হ্যাপি আব্দুল হালিম প্রামাণিক স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার কথা জানতে পারলাম। সারারাত অনেক ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সঙ্গে আমাকেও প্রতিবাদ করতে হবে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সম্রাট স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব। কোথায় এবং কিভাবে করব? আমি ওইদিন বিকেলেই কাউকে না জানিয়েই ট্রেজারার স্যার বরাবর একটা অভিযোগপত্র লিখলাম।

ভেবেছিলাম আগে অভিযোগ দেই তারপর সবাইকে জানাবো। বাসায় এসে নেট খুলে দেখলাম আমার বন্ধুদের একটি বিরাট অংশ স্যারের জন্য প্রাণ দিতে পারে এবং দরকার পরলে অভিযোগকারীর প্রাণ নিতেও পারে। পরের দিন জার্নালিজম বিভাগের চেয়ারম্যান হেলেনা ম্যাম আমাকে ডাকলেন। তাকে সব পরিস্থিতি খুলে বললাম। এবং এটাও বললাম যে, এটা যদি আমার বাবা জানতে পারে কষ্ট পেয়ে হয়তো তিনি হার্ট অ্যাটাকও করতে পারেন। ম্যাম আমাকে বললেন। আপাতত কাউকে না জানিয়েই কতদুর কি হয় দেখ। আমিও চুপচাপ থাকলাম। দুই দুইটা তদন্ত কমিটি হলো। সম্রাট স্যারের সামনে বসে আরো ৬/৭ লোকের সামনে বসে আমাকে বলতে হলো তিনি আমার শরীরের কোথায় কোথায় হাত দিয়েছেন।

প্রথমবার যে তদন্ত কমেটি ছিল তা কিছুটা সহনীয় ছিল কিন্তু দ্বিতীয়বার তো সব ধর্যের সীমা ভেঙ্গে গেছিল। বাবার চেয়েও বেশি বয়সের একজন শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করছে স্যার তোমার কোথায় কোথায় হাত দিয়েছিল আমাকে একটু দেখাও তো। স্যার কি তোমাকে কিছু করেছিল? ওই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আরো একবার লাঞ্ছিত হতে হলো আর একজন শিক্ষকের কাছে। তবে এবার হাত দিয়ে নয় মুখ দিয়ে লাঞ্ছিত করল আমাকে। তারপর ভিসি স্যারের কাছে আবার অভিযোগ করলাম তিনি নিজে আশ্বাস দিলেন ২য় তদন্ত কমিটি তিনি বাতিল করবেন বলেছিলেন প্রায় তিন মাস আগে। কিন্তু কোনো খবর পাচ্ছিলাম না।

গতকাল রাতে হঠাৎ দেখলাম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্যারকে তিরস্কার করা হয়েছে এবং পরবর্তী ২ বছর তিনি পদোন্নতি পাবেন না।

কিন্তু ভিসি স্যার যে বলেছিলেন কমিটি বাতিল করবেন তা না করে তদন্ত কিভাবে হলো? যাইহোক তিনি বিচার তো করেছেন। কারণ অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত না হলে তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না।

যেহেতু তাকে তিরষ্কার এবং দুই বছরের পদোন্নতি থেকে বিরত করা হয়েছে সেহেতু শাস্তি তাকে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আমার প্রশ্ন একজন যৌননিপীড়নকারীর শাস্তি মাত্র তিরষ্কার? মাত্র দুই বছরের পদোন্নতি থেকে বিরত? তাহলে বাঙালি জাতির মা-বোনদের লাঞ্ছিত করার শাস্তি শুধু মাত্র তিরষ্কার! বাহ্ বাংলাদেশ বাহ্!! "

আমি এই বিচার মানি না, আমি এই শিক্ষকের উপযুক্ত শাস্তি চাই। সবার সহযোগিতা প্রার্থনা করছি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর