বাজেটে এবারও অবহেলিত সংস্কৃতি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক  | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৩, ০৯:৩৩ এএম

ঢাকা: অসাম্প্রদায়িক চেতনা গঠন, অন্ধত্বের বিরুদ্ধে লড়াই, পশ্চাৎপদ চিন্তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষ গড়ার জন্য প্রয়োজন শুদ্ধ সংস্কৃতি। অথচ জাতীয় বাজেটে দেখা যায়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সবচেয়ে উপেক্ষিত। অনেক বছর ধরেই সংস্কৃতিকর্মীদের চাওয়া, দেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ হোক সংস্কৃতির জন্য। কিন্তু সেই চাওয়া আজও পূরণ হয়নি। গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ৬৯৯ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে; যা গত অর্থবছরে এই খাতে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৬২ কোটি টাকা বেশি। তবে শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য এই বাজেট ‘অপ্রতুল’ বলে জানান এই অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত বিশিষ্টজনরা। তাদের বিশ্বাস, শিগগির প্রস্তাবিত বাজেট সংশোধন করে সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়াবে সরকার।

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন বলে আসছি, দেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ যেন সংস্কৃতির জন্য রাখা হয়। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হয়, তা হলে প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী সংস্কৃতিচর্চার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সংস্কৃতি খাতের বাজেট আরও বড় হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বাজেট প্রণেতারা এতে গুরুত্ব দেননি। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অক্ষমতা আছে বলেও আমি মনে করি। বাজেটে বরাদ্দ করা টাকাও তারা ঠিকমতো খরচ করতে পারে না। কেন পারে না, সেটা সরকারের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। তা ছাড়া ব্যবহার না করতে পারলেই যে আর বাড়ানো হবে না, সেটাও ঠিক নয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই অর্থ খরচ করে। প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি করে মুক্তমঞ্চ দরকার; যেখানে নিয়মিত নাটক, গান, নৃত্য ও আবৃত্তিচর্চা হবে। সেখানে সংস্কৃতিকেন্দ্রের মতো একটি জায়গা থাকবে, যেখানে সবাই মিলিত হবেন। জেলা-উপজেলার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলেই প্রান্তিক পর্যায়ে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটবে।

নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা যদি সংস্কৃতি খাতকে সত্যিই গুরুত্ব দিত, তা হলে সমাজে বিভক্তি-হানাহানি অনেকটাই কমে যেত। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আমরা প্রতিবার চিৎকার করে যাই, কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয় না। আমাদের শাসকগোষ্ঠী সংস্কৃতিকে সব সময় খুব হেয়প্রতিপন্ন করে। অথচ এই দেশের অভ্যুদয়ের পেছনে সংস্কৃতির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটা সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র। সেই সংস্কৃতিকে আমাদের দেশে শাসকগোষ্ঠী, আমলা, রাজনীতিবিদ সবাই খুব অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেন। সেটার ফলাফল প্রতি বাজেটেই আমরা দেখতে পাই।’ 

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘বাজেটে নাটক, চিত্রকলা, গানের পাশাপাশি গবেষণাকর্মের জন্য কত টাকা বরাদ্দ করা হলো, তা কিন্তু সংস্কৃতিকর্মীরা জানতে পারেন না। আমরা জানি না, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কোন ধরনের গবেষণাগুলোকে অগ্রাধিকার দেবে। বাজেট প্রণয়নের আগে এসব বিষয় নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে মন্ত্রণালয় মতবিনিময় করতে পারে। কিন্তু তা করে না, আর তাই এসব খাতে বরাদ্দ হওয়া টাকাও ফেরত যায়। আমি মনে করি, এসব নিয়ে এখনই গুরুত্বসহকারে ভাবা উচিত। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে শিল্প-সংস্কৃতির বিকল্প নেই। আর এই মাধ্যমে বিকাশ ঘটাতে চাইলে বাজেট আরও বাড়াতেই হবে। এর কোনো বিকল্প পথ নেই।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে বিগত বছরগুলোর মতো এবারও সংস্কৃতিকর্মীরা হতাশ হয়েছি। আমরা মনে করি, এই বাজেটে সংস্কৃতি খাতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে এসেছি যে, জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশ যেন অন্তত সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে এবার জাতীয় বাজেটে শতাংশ হিসেবে গতবারের তুলনায় অনেক কমেছে। আর ৬২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে বলে সেটা বলা হচ্ছে, সেটা তো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর কারণে সেখানেই খরচ হবে বরং ঘাটতি থাকবে। গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত আমরা সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলতে চাই। আমরা অনেকদিন থেকে বলে আসছি ৫০০ উপজেলায় একটা করে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ করার জন্য, শিল্পকলা একাডেমি করার জন্য, সেসব উপজেলায় প্রশিক্ষক নিয়োগের জন্য। কিন্তু সেটির জন্য যে অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ প্রয়োজন সেগুলোর ব্যবস্থা তো এ বাজেটে নেই।’ 

চিত্রনায়িকা রোজিনা বলেন, ‘সমাজে সার্বিকভাবে যে অবক্ষয়ের চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই, সেটা সংস্কৃতির বিপর্যয়ের কারণেই। তাই প্রগতিশীল মনন গঠনে সংস্কৃতি খাতে বাজেট নিয়ে সরকারের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল। আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। তাই এই মাধ্যম সম্পর্কে আলাদা করে বলতে চাই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারকে অবশ্যই সিনেমার দিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। সিনেমাকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতি হবে না। সিনেমা বানিয়ে দেখানোর জায়গা নেই। বাজেটে সিনেমা হল-সিনেপ্লেক্স নির্মাণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কথা প্রত্যাশা করেছিলাম। কীভাবে সিনেমা নির্মাণ বাড়ানো যায়, সেই পৃষ্ঠপোষকতাও দরকার।’

রামেন্দু মজুমদার - আমরা দীর্ঘদিন বলে আসছি, দেশের মোট বাজেটের ১ শতাংশ যেন সংস্কৃতির জন্য রাখা হয়। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হয়, তা হলে প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী সংস্কৃতিচর্চার কোনো বিকল্প নেই

মামুনুর রশীদ - রাজনীতিবিদরা যদি সংস্কৃতি খাতকে সত্যিই গুরুত্ব দিত, তা হলে সমাজে বিভক্তি-হানাহানি অনেকটাই কমে যেত। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু - বাজেটে নাটক, চিত্রকলা, গানের পাশাপাশি গবেষণাকর্মের জন্য কত টাকা বরাদ্দ করা হলো, তা কিন্তু সংস্কৃতিকর্মীরা জানতে পারেন না। আমরা জানি না, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কোন ধরনের গবেষণাগুলোকে অগ্রাধিকার দেবে

রোজিনা - সমাজে সার্বিকভাবে যে অবক্ষয়ের চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই, সেটা সংস্কৃতির বিপর্যয়ের কারণেই। তাই প্রগতিশীল মনন গঠনে সংস্কৃতি খাতে বাজেট নিয়ে সরকারের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল। 

সোনালীনিউজ/এম