নারীদের সংগঠন ‘অপরাজিতা’

  • সালেহীন বাবু | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯, ০২:১১ পিএম

ঢাকা : ‘অপরাজিতা’ একটি সংগঠন যেটি একজন অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতিনিধিত্ব করে। অপরাজিতার কাছে অসাধ্য বলে কিছু নেই। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে দুর্বার ছুটে চলা এক স্বাধীন নারীর অকুতোভয় প্রতিচ্ছবি অপরাজিতা।

পার্বত্যাঞ্চলের প্রথম অনলাইন ব্লাড ব্যাংক ‘জীবন’-এর নারী সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র শাখা ‘অপরাজিতা’। নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা বরাবরই দুশ্চিন্তার বিষয়। এ নিয়ে শুধু একজন নারী নয়, তটস্থ থাকে পুরো পরিবারও। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন কুসংস্কার এবং অঞ্চলভেদে মাসিক ও নারী স্বাস্থ্যের প্রতি নানাবিধ অবহেলা দৃশ্যমান। এই অবহেলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার নিমিত্তে সৃষ্টি অপরাজিতার। মাসিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যা নারীর গর্ব সেই বিষয়টিকে উপহাস করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সমাজে এটিকে বিশেষ প্রাইভেসি হিসেবে ধরা হয়।

অপরাজিতা নারীদের স্বাস্থ্য সচেতন করার পাশাপাশি জীবনমান উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। নারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল করে তুলতে সংগঠনটি মাসিক সম্পর্কে সচেতনতা, মাসিক নিয়ে কুসংস্কার প্রতিরোধ, মাসিককালে স্বাস্থ্যের যত্ন, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভিন্নধর্মী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

প্রতিটি কর্মসূচি অত্যন্ত যুগোপযোগী করে সাজানো হয় যাতে নারীদের সমসাময়িক অবস্থানের সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে। ৩ সেপ্টেম্বর দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘অপরাজিতা’।

ওই দিন বিদ্যালয়ের মিলনায়তনে অনাড়ম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অপরাজিতার লোগো উন্মোচন করেন রাঙামাটি সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন ইসলাম, জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ১৮ বিজয়ী সংগঠন অল ফর ওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান কামরুন নেছা মিরা ও ‘জীবন’-এর সভাপতি আনোয়ারুল কবির। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন- ‘জীবন’-এর সাধারণ সম্পাদক সাজিদ-বিন-জাহিদ (মিকি), বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুবর্ণা চাকমা ও বাসনা চাকমা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপরই শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় কৈশোরবান্ধব কর্মশালা।

কামরুন নেছা মিরা শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান, তারা যেন মাসিকের বিষয়টি নিয়ে কখনো লুকোচুরি না করে এবং এটি পরিবার কিংবা শিক্ষিকাদের অবহিত করে। সাইদা জান্নাত শিক্ষার্থীদের মাসিকের বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পরামর্শ দেন।

‘জীবন’-এর কার্যক্রম ও অপরাজিতা সম্পর্কে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী পার্বত্যাঞ্চলের প্রথম অনলাইন ব্লাড ব্যাংক ‘জীবন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক সাজিদ-বিন-জাহিদ (মিকি) বলেন, ‘পার্বত্যাঞ্চলে কাজ করার সুবাদে জানতে পারি, এই জনপদের মানুষ স্বাস্থ্যের প্রতি খুবই উদাসীন। নারীদের বিষয়ে এই উদাসীনতা আরো ভয়াবহ!

পাহাড়ি জনপদের প্রায় সব গৃহস্থালির কাজে নারীদের সরাসরি সম্পৃক্ততা, এমতাবস্থায় একজন নারী তার মাসিককালে নিজের স্বাস্থ্যের কোনো বিশেষ যত্নই নেন না। অনেকেই ব্যবহার করেন না স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড বা পরিষ্কার কাপড়। অস্বাস্থ্যকর উপায়ে ঋতুস্রাব ঠেকাতে তারা নিজেই নিজেকে ঠেলে দিচ্ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

‘জীবন’ যেহেতু ২০১১ সাল থেকে পার্বত্যাঞ্চলে আস্থার অপর নাম তাই আমরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শাখা ‘অপরাজিতা’ সৃষ্টির মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে পরামর্শ ও ভিন্নধর্মী কর্মশালার আয়োজনের পাশাপাশি থাকবে নিরাপদ স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের মাঝেও পর্যায়ক্রমে এ প্রকল্পটি বিস্তার লাভ করবে।’

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অপরাজিতার কমিউনিকেশন হেড তাহমিনা ইয়াছমিন। তাহমিনা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষার্থীদের মাসিককালে প্রস্তুতি সম্পর্কে করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচ শতাধিক ছাত্রী কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে নতুন করে নিজের সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। বয়ঃসন্ধির সময় শারীরিক পরিবর্তন ও মাসিকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।

শতাব্দী চাকমা নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী অপরাজিতার এমন কর্মসূচির জন্য ‘জীবন’-কে ধন্যবাদ জানায়। সে বলেছে, একজন সহপাঠীর সঙ্গে আমরা যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতেও লজ্জাবোধ করতাম আজ অপরাজিতা আমাদের সেই ভুল ধারণাগুলো থেকে পরিত্রাণের পথ দেখিয়েছে। আমরা এখন থেকে সচেতন থাকব।

রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাসিককালে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে এবং স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারে উৎসাহিত করতে তাদের বিদ্যালয়ে একটি ‘ডিগনিটি বক্স’ উপহার দেন অপরাজিতার সদস্যরা। ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন ইসলাম এমন কর্মসূচির আয়োজন করায় অপরাজিতা টিমকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

মাসিকবান্ধব টয়লেট কর্মসূচির আওতায় আনা হয় বিদ্যালয়টিকে যা শিক্ষার্থীদের নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবে। মাসিকের জন্য আর কোনো শিক্ষার্থীকে যেন স্কুল বন্ধ না করতে হয় সে জন্যই স্কুলে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় ‘ডিগনিটি বক্স’।

‘অপরাজিতা’-র প্রোগ্রাম লিডার সাইদা জান্নাত বলেন, ‘নারীদের মাসিক ছোট করে দেখার মতো কিংবা অবহেলার বিষয় নয়। পুরুষরা প্রায়ই বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে নেয়। কুসংস্কার এবং সঠিক স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে কিশোরী বয়স থেকেই অনেক মেয়ে নিজের যত্ন নিতে পারে না। জরায়ু ক্যান্সার কিংবা স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব হতে পারে অসচেতনতার চরম পরিণতি। তাই বয়ঃসন্ধি, মাসিক এবং আত্মরক্ষামূলক শিক্ষার প্রসার ঘটাতেই ‘অপরাজিতা’। নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষাও দেওয়া হবে অপরাজিতার পক্ষ থেকে।’

বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী একজন অপরাজিতা, এই প্রত্যাশা টিম অপরাজিতার। অপরাজিতা ভবিষ্যতে নারীবান্ধব গণপরিবহন ও কর্মস্থল বাস্তবায়নে কাজ করবে। এ ছাড়া, প্রতিটি হাসপাতাল ও কর্মস্থলে নিরাপদ ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টার বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে অপরাজিতা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই