ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয় হাজার কোটি টাকার খাদ্যশস্য

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০১৯, ০২:৩৯ পিএম

ঢাকা : সারাবিশ্বে পোল্ট্রি শিল্প ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং  পোল্ট্রি উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্পে ইঁদুর দ্বারা অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে লক্ষ রেখে মুরগির খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, যাতে সমন্বিতভাবে ইঁদুর দমনে অংশগ্রহণ করে এবং খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

দেশের আবাদি জমির ফসলের একটা বড় অংশ ইঁদুর নষ্ট করছে। প্রতিবছর ইঁদুরের কারণে বিনষ্ট খাদ্যশস্যের পরিমাণ প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টন। এ খাদ্যশস্য প্রায় ৬০ লাখ মানুষের খাবার চাহিদা মেটাতে পারত।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) এক জরিপ অনুযায়ী, ইঁদুর দ্বারা আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গমের ৮ থেকে ১২ ভাগ, গোল আলুর ৫ থেকে ৭ ভাগ, আনারসের ৬ থেকে ৯ ভাগ, শাকসবজির ৪ থেকে ৫ ভাগ, নারকেল বাগানের ৮ থেকে ৯ ভাগ এবং সেচ নালার ৭ থেকে ১০ ভাগ পানি ইঁদুরের কারণে নষ্ট হয়ে থাকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। মাঠ থেকে শুরু করে গোলাঘর পর্যন্ত উৎপাদিত কৃষিপণ্যের একটা বিরাট অংশ নষ্ট করছে ইঁদুর। ছোট প্রাণী হলেও ইঁদুরের কারণে ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক। ইঁদুর প্রতিনিয়তই কৃষকের কষ্টার্জিত ফসলের ক্ষতি করছে।  

মাঠের শস্য  কেটেকুটে নষ্ট করে, খায় এবং গর্তে জমা করে।

২০১৭ সালের এক হিসাব থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের ফসলহানি করছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনিষ্টকর মেরুদণ্ডী প্রাণী দমনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, অনিষ্টকর প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর মাঠ ফসল উৎপাদন ও গুদামজাত শস্য সংরক্ষণের  ক্ষেত্রে একটি প্রধান সমস্যা।

তাছাড়া ইঁদুর মুরগির খামারে গর্ত করে, খাবার খেয়ে ডিম ও ছোট মুরগি খেয়ে প্রতি বছর খামার-প্রতি প্রায় ১৮ হাজার টাকা ক্ষতি করে থাকে।

এরা বই খাতা, কাপড়, আসবাবপত্র, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেটে নষ্ট করে। এছাড়া এরা অনেক সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটায়। এজন্য ইঁদুর দমন অত্যন্ত জরুরি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিতথ্য সার্ভিস শাখার ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি খাদ্য গুদাম, পাউরুটি ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা পণ্যের দোকানে বিপুল পরিমাণে খাদ্য ইঁদুর নষ্ট করছে।

এর কোনো হিসাব সরকারিভাবে করা হয় না। খাদ্যশস্য ছাড়াও মুরগির খামারে গর্ত করাসহ ডিম ও ছোট মুরগি খেয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করছে ইঁদুর।

মাঠের দানা জাতীয় শস্য, মাটির নিচে হওয়া আলু, মুলা, গাজর, ওলকপি জাতীয় ফসল নষ্ট করছে ইঁদুর।

এছাড়া ফসলের ক্ষতির বাইরে বই-খাতা, কাপড়, আসবাব, বিছানাপত্র, ইত্যাদি কেটে বড় ধরনের ক্ষতি করছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ নালায় গর্ত করে মারাত্মক ক্ষতি করা থেকে শুরু করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতও ঘটাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক  সংস্থা ইউএসএডি-এর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের উপদ্রপ নিয়ে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রব এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মমপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য বেশ অনুকূল।

ফসলের মাঠ ছাড়াও এ অববাহিকায় অবস্থিত হাঠ-বাজার ও শিল্পাঞ্চলগুলোতেও ইঁদুরের দাপট বেশি পরিলক্ষিত হয় (ইউএসডিএ, ২০১০)।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ইঁদুরের উপদ্রবে ফসলের ক্ষতি হওয়া ১১টি দেশকে চিহ্নিত করেছে। বলেছে বাংলাদেশের অর্ধেক জমির ফসল ইঁদুরের আক্রমণের শিকার হয়। ইরির অন্য গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান-গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর  থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষাকৃত ফসলের পরিমাণ প্রায় ৮৯ হাজার টন। আর ২০১৭ সালে নিধন করা হয়েছে এক কোটি ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯০৪টি ইঁদুর।

২০১৫ সালে ইঁদুরের আক্রমণ থেকে রক্ষাকৃত ফসলের পরিমাণ প্রায় ৯৫ হাজার টন এবং নিধন করা হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ১৮১টি ইঁদুর।

কৃষি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কমছে না ইঁদুরের উৎপাত। ইঁদুরকে মানুষের ব্যক্তিগত ও জাতীয় সমস্যা বলে অভিহিত করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)। একটা ইঁদুর বছরে ১০-১২ কেজি খাবার নষ্ট করে এবং এদের বাচ্চা দেওয়ার হারও বেশি।  
দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত ১৩ প্রজাতির ক্ষতিকর ইঁদুর খাদ্যে বিষক্রিয়াসহ প্রায় ৪০ রকমের  রোগ বিস্তার করে। মলমূত্র ও লোম খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে টাইফয়েড, জন্ডিস, কিডনির সংক্রমণ, চর্মরোগ, কৃমিরোগসহ ৪০ প্রকারের রোগ ছড়ায়।

মারাত্মক প্লেগ রোগের বাহকও এই ইঁদুর। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক তার কেটে অগ্নিকা- ঘটানো, টেলিফোনের তার কেটে লাইন বিকল করে দেওয়া, কম্পিউটারসহ ঘরের কাপড়চোপড়, কাগজপত্র কেটে নষ্ট করে ইঁদুর। রাস্তা, বাঁধ, রেললাইনে গর্ত করার ফলে বন্যার সময় পানি ঢুকে যায়। ফলে রাস্তা, বাঁধ ও রেললাইন ভেঙে যায়।

ইঁদুরের শত্রু দাঁড়াশ সাপ : দাঁড়াশ একটি নির্বিষ সাপ। এর প্রধান খাবার ইঁদুর। ইঁদুর খেয়েই সে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি কৃষকের বন্ধু হিসেবে কাজ করে। বাস্তবে কৃষকের বন্ধু হলেও অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের কারণে এই সাপকে মানুষের হাতে প্রাণ দিতে হয় প্রতিনিয়ত।

দাঁড়াশ সাপ সর্বোচ্চ ৩৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। দাঁড়াশ সাপ কৃষি জমিতে থাকতে পছন্দ করে এবং যে জমিতে থাকে তার আশে পাশে প্রায় ৩ একর এলাকা সে বিচরণ করে এবং এই জায়গায় খুঁজে খুঁজে ইঁদুর শিকার করে যার ফলে ইঁদুরের কারণে যে ফসল হানি ঘটে তা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

জাবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, দাঁড়াশ কেন পৃথিবীর কোনো সাপই দুধ চুষে খেতে পারে না। গরুর উলুনে এক ধরনের পোকায় কামড় দেয় যার ফলে কামড়ের দাগ পড়ে কিন্তু সাধারণ কৃষক এই দাগ দেখেই ভ্রান্ত ধারণা থেকে প্রচার করে সাপে গাভীর দুধ খায়।

এ সাপটি সম্পূর্ণভাবে বিষযুক্ত, তার গায়ে কোনো কাঁটা নেই । বিপুল অঙ্কের রবি ফসল বাঁচাতে এই সাপের প্রজনন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা উচিত। এর জন্য তার আবাসস্থল ধ্বংস এবং প্রজনন সমস্যা দূর করতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই