হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক মাছের প্রাচুর্যতা

  • এম আরমান খান জয়, গোপালগঞ্জ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০১৭, ০২:২৮ পিএম

গোপালগঞ্জ: মাছে ভাতে বাঙালির এই দেশে, মাছ দেশীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অংশ। নদীর দেশ বাংলাদেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ বা জলের দেশ বাংলাদেশ, ধান আর মাছের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় মাছ ছিল বাঙালির প্রতিদিনের খাদ্য। কিন্তু আজ নতুন প্রজন্মের অনেকেই দেশি মাছই চেনে না। আমরা যারা এই সময় বাজার করি তারা মাছ বিক্রেতা যে নাম বলে সে নামেই আমরা মাছ কিনে থাকি। আমাদেরকে এক সময় বলা হত, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এই কথাগুলো আমাদের দেশের এই প্রজন্মের মানুষরা কিতাবে জানলেও কিছুদিন আগেও এ কথাগুলোর সাথে বাস্তবতার বেশ মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল। অথচ স্বাধীনতার পর দেশের মানুষ ক্রমবৃদ্ধির কারণে সীমিত সম্পদের উপরে অব্যাহত চাপে যতগুলো খাত ঝুঁকি বিবেচনায় হুমকির মধ্যে পতিত হয়েছে তার মধ্যে মৎস্য সম্পদ কিংবা মৎস্য খাত তার প্রাচুর্যতা হারিয়েছে সমান তালেই।

আর তার প্রকৃত কারণ হল- পানি দূষণ এবং বিষণ। দেশের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণের একমাত্র রিসোর্স পানির আধার বলতে আমাদের ছিল অসংখ্য নদী, হাওর, বাওর, নালা, বিল, পুকুর, দিঘী, সাগর আর এখানকার পানি। সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত কয়েক বছরে দেশের ১৭টি নদী হারিয়ে গেছে দেশের মানচিত্র থেকে। আরো প্রায় ১০টি নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। মাছ চাষের উৎস খাত বলতে এখন রয়েছে স্থায়ী ও মৌসুমী পুকুর ২৪১৫০০ হেক্টর, বাওর ৫৪৮৮ হেক্টর, বিল (আধা চাষ যোগ্য বদ্ধবিল সহ) ১,১৪,১৬১ হেক্টর। সেই সূত্র মতে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর আয়তনের জলাভূমি বিল বাঘিয়া এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর, কাশিয়ানী ও সদর উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার আটশ’ নব্বই হেক্টর আয়তনের বৃহৎ জলাভূমি চান্দা বিল। এ দুটি বিলের মধ্যে একসময় সরাসরি যোগাযোগ বা অখন্ডতা থাকলেও এখন শুধু মাত্র দুই-একটি খাল-নালার মাধ্যমে বিল দুটির মধ্যে সংযোগ রয়েছে।

এই বিল দুটি মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের জন্য বৃহত্তর ফরিদপুর সহ সারাদেশে এমনকি পাশবর্তী দেশেও কম-বেশি পরিচিত। এক সময় এখানকার বুকলাল দেশীয় কৈ, শিং, মাগুর, শোল, গজার, পুঁটি, খয়রা, ভেদা, বাইম, পাবদা, বেলে, রুই, কাতলসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট বড় মাছের জন্য বিল বাঘিয়া ও চান্দা বিলের পরিচিতি ছিল খুব বেশি। এই বিল দুটি থেকে উৎপাদিত মাছ শুধু এলাকার চাহিদাই মিটাচ্ছে না, এখানকার মাছ যাচ্ছে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। একসময় এখানকার বুকলাল দেশীয় কৈ, শিং, মাগুর, কোলকাতায় ছিল ব্যাপক চাহিদা। জ্যৈষ্ঠ থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত এই বিলে পানি পরিপূর্ণ থাকে তখন কয়েক হাজার মৎস্যজীবী বিভিন্ন ধরনের জাল, বড়শি, বাঁশের চাই, ঝুপী, কোচ, ভেসাল ইত্যাদি দিয়ে মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব বিলের মধ্যে অজস্র কুয়ায় বা পুকুরে মাছ অবস্থান নেয়, তা সেচ দিয়ে কুয়া মালিকরা আহরণ করে। এই বিল দুটি থেকে শুধু কাচা মাছই ধরে বিক্রি করা হয় না, এখানকার মিঠা পানির মাছ শুকিয়ে খুবই ভালো মানের শুঁটকি তৈরি করা হয়। যার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশসহ বিদেশেও। কার্তিক, অগ্রাহয়ণ ও পৌষ মাসে শুটকি ব্যবসায়ীরা এসব এলাকায় ভীড় করে। শুধু শুটকি মাছই নয়-প্রতিদিন অন্তত ৮/১০ ট্রাক কাঁচা কৈ ও জিয়াল মাছ ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। ফলে এলাকার ব্যাংকগুলিও তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সাম্প্রতিক সময়ের মৎস্য উদ্বৃত্ত এলাকা হিসাবে পরিচিত এ দুটি বিল এলাকায় এখন মৎস্য ঘটতি দেখা দিয়েছে। বিল বাঘিয়া ও চান্দা বিল থেকে মিঠা পানির এই সুস্বাদু মাছ ব্যাপকহারে দিন দিন কমে যাচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্তও হয়ে গেছে, কিছু প্রজাতি আছে হুমকির মুখে। মাছ কমে যাওয়া ও হারিয়ে যাবার কারণ হিসেবে জানা যায়, বিলে এখন আর আগের মত বর্ষার পানি আসে না, বিলগুলির চতুর্দিকে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করায় পানি চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হয় এবং পানি পচে যায়। ফলে মাছের অবাধ বিচরণও মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যবস্থাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে শ্রেণিভেদে মাছ আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে মৎস্যজীবীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা নানা কৌশলে বৈধ-অবৈধ যন্ত্রপাতি দিয়ে ছোট-বড় মাছ নির্বিশেষে আহরণ করছে, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অবাধে ডিমওয়ালা মাছ, মা মাছ, ছোট মাছ মেরে ফেলছে। এছাড়া বিল দুটির কুয়াগুলি বার বার সেচ দিয়ে সেখান থেকে সব ধরনের মাছ আহরণ করা হচ্ছে। ফলে পরবর্তী মৌসুমে বংশ বৃদ্ধির জন্য মাছ আর তেমন থাকছে না। বিল অঞ্চলের সচেতন মহলের মতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ডিমওয়ালা মাছ ও ছোট রেণুপোনা মাছ আহরণ বন্ধ রাখা এবং কুয়া, খাল-নালা থেকে একাধিকবার সেচ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা হলে এখানকার প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ হয়ত বিলুপ্তির হাত থেকে রাখা পাবে।

তাছাড়া মধুমতি বাঘিয়ার তীরে গোপালগঞ্জ শহর ছিল এক সময়ের প্রসিদ্ধ মাছের বাজার। এই শহরের আশে-পাশে সব নদী খাল বিল জলাশয়ে পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণ দেশীয় মাছ। এখানের বেশির ভাগ মানুষই মাছ ধরে জিবীকা নির্বাহ করতো। মধুমতি এখন মৃত প্রায়। এক সময়ের নাম করা মধুমতি নদীর ইলিশ মাছ দুই বাংলায় প্রচুর চাহিদা ছিল। মধুমতি নদীর ইলিশ মাছের স্বাদই ছিল আলাদা। প্রবাদ আছে মধুমতি নদীর ইলিশ মাছ রান্না করলে ঘরের বিড়াল মেউ মেউ করে চারপাশে ঘুড়তো এই মাছের ঘ্রাণে। এক সময়ের খরশ্রোত মধুমতি নদী ছিল গোপালগঞ্জের চারপাশের যাতায়াত ব্যবস্থা। এখন সেখানে রাস্তা হয়েছে। নদি, খাল জলাশায় ভরাট হয়ে গেছে। বাকি যতটুকু আছে সেখানে এক শ্রেণির প্রভাবশালীরা বন্ধ করে বিদেশি প্রজাতির মাছের চাষ করছে। ফলে দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সরকার জানান, প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ্য মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত সরকারি আর্থিক সহযোগিতা ও স্থানীয় জেলেদের সচেতন করার পাশপাশি ১৯৮৫ সালের জলাধার সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ করা প্রয়োজন। যে মাছগুলো আমাদের অজান্তেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বা অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চরম বিপন্ন প্রজাতির সেই মাছগুলো হলো- ভাঙন, নান্দিনা, ঘোড়া মুখো, সরপুঁটি, মহাশোল, রিটা, ঘাউড়া, বাচা, দেশি পাঙ্গাশ, বাখাইর, সিসর, চেনুয়া ও পিপলা শোল। আবার বিপন্ন প্রজাতির মাছগুলো হলো- চিতল, জয়া, খোকশা, কাশ খইরা, কালি বাউশ, ঘন্যা, ঢেলা, ভোল, দারকিনি, রানি, পুতুল, বউমাছ, গুইজ্যা, আইড়, বাটা সিও, টেংরা, কানি পাবদা, মুধু পাবদা, গজার, নাপিত কৈ, বিশতারা, বাইম, শাল বাইন, অ্যালং ইত্যাদি। পরিশেষে, পানির অভাবে যুদ্ধ বাড়ছে। অল্প পানির বহুবিধ ও সমন্বিত ব্যবহার করতে আমরা পাড়ছি না। ভূ-উপরিভাগের বাড়তি পানি আমরা রিজার্ভ রাখতেও পাড়ছি না। যতটুকু পানি নিয়ে আমাদের চলন তাও বিষাক্ততায় ভরা। আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও ছেলেবেলা আজ পানির অভাবে রূপকথার মত। আইনের প্রয়োগহীনতা আর স্বাভাবিকতার উপর বলপ্রয়োগের কারণে পানিতে বিষ মিশিয়ে দূষণ করে প্রকৃতির আপন সৃষ্টির সম্পদকে হত্যা করছি অহরহ। ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের গর্ব করার যেমন কিছু নেই, আবার নেই আমাদের কোনো প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতা।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর