ঝালকাঠিতে ৪০০ ব্রিজের ২১৪ মরণফাঁদ

  • ঝালকাঠি প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০১৮, ০৬:৪৯ পিএম

ঝালকাঠি : জেলায় এলজিইডির আওতাধীন আয়রন ব্রিজগুলো একের পর এক ভেঙে গিয়ে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেলার মোট ৪০০ আয়রন ব্রিজের ২১৪টিই ব্যবহার অনুপযোগী। এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশত বিধ্বস্ত। এর মধ্যে সিডরে বিধ্বস্ত ব্রিজও রয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে নির্মিত এসব ব্রিজ সংস্কার কিম্বা প্রতিস্থাপন না করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে ব্রিজগুলো পুনর্নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চেয়ে পাঠানো হয়েছে।

ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালিঘোনা গ্রামের বঙ্গবন্ধু বাজার এলাকার ব্রিজটি (আয়রন-ঢালাই) প্রায় দুই বছর আগে আকস্মিক ভেঙে গাভারামচন্দ্রপুর ও বিনয়কাঠি এ দুই ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগে রয়েছে দুই ইউনিয়নের ৬ গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয়রা দ্রুত ব্রিজটি নির্মাণের জন্য কর্তৃপক্ষকে জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা সুরাহা পাননি। সব চেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী এবং স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীরা। সেতুর অভাবে কয়েক মিনিটের পথ দীর্ঘ কয়েক মাইল পথ ঘুরে পায়ে হেটে যাতায়াত করতে হচ্ছে। যানবাহনের অভাবে ওই এলাকার অসুস্থ রোগীদের সময়মত হাসপাতালে নেয়া যাচ্ছে না। সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিতে না পারায় চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগীর মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ব্রিজটি।

একাধিক স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৮ সালে এলজিইডির আওতায় প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালিঘোনা ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের পূর্ব আশিয়ার গ্রামের খালের ওপরে এ ব্রিজটি নির্মাণ করা হলে দুই গ্রামের সংযোগ হয়। নির্মাণের সময় নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা অবকাঠামোগতভাবে নরবরে ছিল এ ব্রিজটি, অভিযোগ স্থানীয়দের। এ ছাড়া মাদকসেবীরা ব্রিজের খুটির এ্যাঙ্গেল চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় গত ২ বছর পূর্বে ব্রিজটি আকস্মিক ভেঙে খালে পড়ে যায়। ঝালকাঠি সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নের আশিয়ার ও মুড়াশাতা এবং গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের কালিয়ারগোক ও বালিঘোনাসহ ৫/৬টি গ্রামের মানুষ এ ব্রিজের অভাবে সড়ক পথে যাতায়াত করতে পারছে না। সময়মত স্কুল ও কলেজে যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। যে কারণে সমস্যায় পরে অনেকেরই লেখাপড়া বিঘ্ন ঘটছে।

মুড়াশাতা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক জানান, ব্রিজটা ভাল থাকলে অনেক কম সময়ে মোটরসাইকেলে করে জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে পারতাম। কিন্তু এখন তো তা পারছি না। সময়ের কাজ সময়মত না করতে পারলে লাভ কি? বালিঘোনা গ্রামের কলেজ ছাত্র রবিউল ইসলাম জানান, ব্রিজের অভাবে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ অনেক দূর ঘুরে কয়েক কি. মি. পথ পায়ে হেটে প্রতিদিন কলেজে যেতে হচ্ছে। সময় মতো কোনো ক্লাস করতে পারছি না। আমরা দ্রুত এই ব্রিজটি নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি।

গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মাওলা মাসুম শেরওয়ানী জানান, ব্রিজটি ভেঙে যাওয়ার কারণে গাভারামচন্দ্রপুর ও বিনয়কাঠি ইউনিয়নের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। খুবই দ্রুত ব্রিজটি নির্মাণ করা প্রয়োজন। ওই দুই ইউনিয়নের মানুষ এ সমস্যা সমাধানে শিল্পমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বিনয়কাঠি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম জানান, ব্রিজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত ব্রিজটি নির্মাণের জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করবেন।

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার পোনাবালিয়া খালের ওপর অবস্থিত নলছিটির নাচনমহল ও পোনাবালিয়া দুই ইউনিয়নের সংযোগ রক্ষাকারী ব্রিজটি ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে বিধ্বস্ত হয়। এর পরে ভাঙা অংশে স্থানীয়রা বাঁশ এবং সুপারি গাছ দিয়ে যোগাযোগ সচল রেখেছে। জেলায় বিভিন্ন সময় বিধ্বস্ত এ ধরনের ব্রিজের সংখ্যা অন্তত ৫০টি। নড়বড়ে ব্যবহার অনুপযোগী ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ রয়েছে আরো ১৬৪টি। এসব ব্রিজের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল তো দূরে থাক শিশু এবং বৃদ্ধরাও চলাচল করতে পারে না। কোথাও বিকল্প ব্যবস্থায় নৌকায় আবার কোথাও ঝুঁকি নিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে। স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীদের যাতায়াত রোগী এবং পণ্য আনা নেয়া করা কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ভেঙে পড়া সেতুতে কাঠের পাটাতন কিম্বা বাঁশের সাঁকো তৈরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করছে স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ হাজার মানুষ।

সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় কয়েকটি সড়ক সংস্কার করা হলেও ১০ বছরেও সিডরে বিধ্বস্ত ২০টি সেতুর সবগুলো সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। এসব সেতুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ টেকেরহাট-পোনাবালিয়া সংযোগ সেতু, নাচনমহল-রানাপাশা সংযোগ সেতু, সরমহল-পুনিহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সেতু উল্লেখ যোগ্য। এগুলো দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না।

কে এ খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল বারেক মিয়া জানান, সদর উপজেলার পোনাবালিয়া এবং নলছিটি উপজেলার টেকেরহাট এলাকার সংযোগ স্থাপনকারী সেতুটির এক অংশ সিডরে ভেঙে যায়। এর পর থেকে স্থানীয় লোকজন নিজেদের উদ্যোগে প্রতিবছর চাঁদা তুলে এবং গ্রাম থেকে বাঁশ ও সুপারি গাছ সংগ্রহ করে ভাঙা অংশে সাঁকো তৈরি করে দুই এলাকার সংযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করে আসছে। তিনি জানান, এ সেতুটির দুই পাড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির, হাট-বাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পোনাবালিয়া ইউনিয়ন আ. লীগ সভাপতি মো. মজিবুর রহমান জানান, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুটি দীর্ঘ ১০ বছরেও মেরামত না হওয়া অত্যন্ত দুঃখ জনক।

ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার চেচঁরীরামপুর ইউনিয়নের বানাই-মহিষকান্দি বাকেরখালের ওপর আয়রন ব্রিজটি ভেঙে প্রায় ৬ বছর ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে । ২০১২ সনের ৭ সেপ্টেম্বর সকালে আকস্মিকভাবে ব্রিজটি ভেঙে পরে। এরপর থেকে এলাকাবাসী নদী পারাপারে চরম দুর্ভোগে পরে। ব্রিজটি ভেঙে যাওয়ায় কাঠালিয়া বানাই-পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া-মঠবাড়িয়ার সঙ্গে সড়কপথে পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কাঠালিয়া তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ডিগ্রি কলেজ, বানাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বানাই বালিকা বিদ্যালয়সহ ১০-১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও প্রায় লক্ষাধিক মানুষের চলাচলে ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। স্কুল-শিক্ষক বজলুর রশীদ খান খোকন বলেন ব্রিজটি ভেঙে যাওয়ায় ২০ কিলোমিটার ঘুরে ভান্ডারিয়া হয়ে কাঠালিয়া শিক্ষা অফিসে যেতে হয়। এতে সময় অর্থ দুটিই অপচয় হচ্ছে।

এলাকাবাসী জানায়, ব্রিজটি ভেঙে সম্পূর্ণ পানিতে ডুবে না যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগের সঙ্গে নৌ যোগাযোগও অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। নদী সরু হয়ে নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। ভাঙা ব্রিজটি সড়ক ও জনপথ বিভাগ অপসারণ না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চেঁচরীরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন ফরাজী জানান, বিগত ৬ বছর পূর্বে একটি কাঠ বোঝাই ট্রলারের ধাক্কায় ব্রিজের তিনটি খুঁটি ভেঙে ব্রিজটি পরে যায়। এ বিষয়টি এলজিইডি ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীদের সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো কাজ হয়নি।

কাঠালিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এম আর শওকত আনোয়ার জানান, সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় পুলিশের টহল গাড়ি নিয়ে বানাই পশ্চিম চেঁচরী, বায়েলাবুনিয়া, কালিশংকর এলাকায় যেতে না পারায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কাঠালিয়া উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী অমল চন্দ্র রায় জানান, ১৯৯২ সালে এলজিইডি এ সেতুটি নির্মাণ করে। ১৯৯৮ সালে এ রাস্তাটি সওজের আওতায় চলে যাওয়ায় এ ব্রিজের দেখ ভাল করার দায়িত্ব এখন তাদের।

ঝালকাঠি এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. ফুলকাম বাদশাহ বলেন, ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জেলায় ৪০০টি আয়রন ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ২১৪টি প্রতিস্থাপনের জন্য ২৩৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সদর উপজেলার ৭৭টি ব্রিজের জন্য ৮২ কোটি টাকা, নলছিটির ১৬ টির জন্য সাড়ে ৯ কোটি, রাজাপুরের ৪৪টির জন্য ৩৫ কোটি এবং কাঠালিয়া উপজেলার ৭৭টি ব্রিজের জন্য ১০৭ কোটি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই টেন্ডার আহবান করে দ্রুত ব্রিজগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর