বজ্রপাতের কারণ ও বাঁচার কৌশল

  • ফিচার ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ৩, ২০১৮, ১০:১২ পিএম

ঢাকা : সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। বিশেষ করে জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির প্রবণতা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই সব ছাপিয়ে এখন বজ্রপাত নামে প্রকৃতির একটি ক্রিয়া প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বজ্রপাত বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। একই সঙ্গে এর কারণে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। বছরের বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে বজ্রপাতে অসংখ্য মানুষ মারা যাওয়ার খবর।

গবেষকদের মতে, পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও ১০০ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আর দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে কমপক্ষে ৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বজ্রপাত প্রকৃতির বিষয় এবং এটি হবেই। একটু সচেতন থাকলেই বাঁচা যেতে পারে বজ্রপাত থেকে, কমতে পারে সারা দেশের বজ্রপাতজনিত প্রাণহানি। তবে এর আগে আমাদের জানা দরকার বজ্রপাত কেন হয়?

কেন হয় বজ্রপাত : বজ্রপাত সংঘটনের বিষয়টি বুঝতে হলে দুটি বিষয়ে ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রথমত, নিরক্ষ অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চল পর্যন্ত সূর্যরশ্মির পতন কোণ। দ্বিতীয়ত, বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহের উলম্ব বিস্তার। নিরক্ষরেখা পৃথিবীর মাঝ বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে আছে। এখান থেকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সমান দূরত্বে অবস্থিত। সূর্য নিরক্ষ অঞ্চলে প্রায় সারা বছর লম্বভাবে এবং মেরু অঞ্চলে তির্যকভাবে কিরণ দেয়। ফলে নিরক্ষ অঞ্চল প্রায় সারা বছর উত্তপ্ত থাকে এবং মেরু অঞ্চল শীতল থাকে। যে কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে (উষ্ণমণ্ডল) বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে।

অপরপক্ষে বায়ুমণ্ডলের উলম্ব বিস্তার অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন নিকটবর্তী স্তর হচ্ছে ট্রপোস্ফিয়ার। এরপর স্ট্রাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার এবং থার্মোস্ফিয়ার। ট্রপোস্ফিয়ারের গড় গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত, স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ট্রপোস্ফিয়ারের ওপর থেকে ৪৭-৪৮ কিলোমিটার পর্যন্ত, মেসোস্ফিয়ারের স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওপর থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং মেসোস্ফিয়ারের ওপর থার্মোস্ফিয়ার বা আয়োনোস্ফিয়ার অবস্থিত। তাপমাত্রার উলম্ব বিস্তারণ বায়ুমণ্ডলের এসব স্তরকে অনুসরণ করে হ্রাস বা বৃদ্ধি পায়। ট্রপোস্ফিয়ারে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং শেষ সীমায় স্থিতিশীল থাকে যাকে ট্রপোপজ বলে। এরপর স্ট্রাটোস্ফিয়ারে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং শেষ সীমায় স্থিতিশীল থাকে যাকে স্ট্রাটোপজ বলে।

অতঃপর মেসোস্ফিয়ারে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং শেষ সীমায় স্থিতিশীল থাকে যাকে মেসোপজ বলে। মেসোপজের ওপর অবস্থিত আয়োনোস্ফিয়ারে আবার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং এই স্তরের ওপরের দিকের তাপমাত্রা প্রায় ১৩৮০ সেন্টিগ্রেড। এই আয়োনোস্ফিয়ার বজ্রপাত সংঘটনের অন্যতম অনুঘটক। আয়োনোস্ফিয়ারের মূল উপাদান হলো আণবিক নাইট্রোজেন এবং পারমাণবিক অক্সিজেন। এই দুই উপাদান সূর্যের গামা ও এক্স রশ্মি শোষণ করে। ফলে প্রতিটি অণু ও পরমাণু ধন্মাক ইলেক্ট্রন সৃষ্টি করে যা আয়ন নামে বেশি পরিচিত। এসব মুক্ত আয়ন পৃথিবীর চারদিকে বলয় সৃষ্টি করে। সাধারণ বা মেঘমুক্ত আবহাওয়ায় ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ আয়োনোস্ফিয়ার থেকে পৃথিবীতে আসে।

এভাবে কেবল ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ আসতে থাকলে পৃথিবীর ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ ১০ মিনিটের মধ্যে নিষ্ক্রীয় হয়ে যেত। বজ্রপাতের সময় ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ পৃথিবীতে এসে পৃথিবীর ঋণাত্মক চার্জ বজায় রাখে। পৃথিবীতে একসঙ্গে প্রতি মুহূর্তে প্রায় ১৮০০ বজ্র ঝড় বিদ্যুৎ চমকের মাধ্যমে পৃথিবীর ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ বজায় রাখতে সাহায্য করে।

দিনের বেলায় সূর্যের রশ্মির কারণে জলভাগ ও স্থলভাগ  থেকে জলীয় বাষ্প এবং উদ্ভিদের প্রস্বেদনের ফলে ত্যাগকৃত জলীয়বাষ্প বায়ুমণ্ডলের ওপরের দিকে উঠে আসে।

উল্লেখ্য, নিরক্ষীয় অঞ্চলে বেশি পরিমাণে সূর্য রশ্মি পতিত হওয়ায় এই অঞ্চলে বাষ্পীয়-প্রস্বেদনের হার বেশি। এই জলীয় বাষ্প ওপরে উঠে শীতল হতে থাকে। এক পর্যায়ে হিমাঙ্কে পৌঁছালে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ধূলিসহ অন্যান্য ক্ষুদ্রকণাকে ঘিরে ঘনীভ‚ত হতে থাকে যা প্রথমে জলকণায় এবং আরো শীতল হলে বরফ কণায় পরিণত হয়। এভাবে মেঘের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের মেঘকে থান্ডার ক্লাউড (Thunder Clouds) বলে।

অন্যান্য মেঘের মতো এ মেঘে ও ছোট ছোট পানির কণা থাকে। আর ওপরে উঠতে উঠতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে পানির পরিমাণ যখন ৫ মিলিমিটারের বেশি হয়, তখন পানির অণুগুলো আর পারস্পরিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না। তখন এরা আলাদা (Disintegrate) হয়ে যায়, ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক আধানের (Electric Charge)-এর সৃষ্টি হয়। আর এ আধানের মান নিচের অংশের চেয়ে বেশি হয়। এ রকম বিভব পার্থক্যের (Protential difference) কারণেই ওপর থেকে নিচের দিকে বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন (Transmission) হয়। এ সময় আমরা আলোর ঝলকানি (Lightning) দেখতে পাই। আর ক্রিয়ার সময় ওই এলাকার বাতাসের প্রসারণ (Expansion) এবং সংকোচনের (Contraction) ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে।

আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের গোড়া পর্যন্ত বিহারের মালভূমি অঞ্চলে নিম্নচাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। তখন বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ু প্রবাহ এই নিম্নচাপ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায়। এই ছুটে আসা আর্দ্র বায়ু প্রবাহ এই দুইয়ের সংঘাতে একটি-দুটি করে বজ্র মেঘের সৃষ্ট হয়।

আর সেগুলো তীব্র গতিতে মাথা তুলতে থাকে। এই মেঘগুলো থেকে নিঃসৃত শীতল ঝড়ের জাপটা (Cold down draft) সামনের দিকে আঘাত করে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ুস্তর ওই ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে ওপরে উঠে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গায় নতুন করে বজ্র-মেঘ সৃষ্টি হয়।

সবচেয়ে প্রথম যে একটি দুটি মেঘ তৈরি হয়েছিল তাদের জননী (Mother Thunder Storm) বলা হয়। তবে সামনের দিকে সৃষ্ট হওয়া নতুন বজ্র-মেঘগুলোকে বলা হয়  মেয়ে (Daughter Thunder Storm)। এভাবে সামনের দিকে ক্রমে অনেক বজ্রমেঘ সৃষ্টি হয়ে একটা রেখা বরাবর দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগোয়।

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল

১. বজ্রপাতের সময় কোনো খোলা মাঠে বা খোলা স্থানে দাঁড়াবেন না, যদি ওই স্থানে কোনো বড় গাছ না থাকে, তবে আপনি সেই স্থানের সব থেকে উঁচু ব্যক্তি। সেই সঙ্গে কোনো গাছের নিচে আশ্রয় নেবেন না। গাছের ওপর বজ্রপাত বেশি হয়।

২. পানির কাছে থাকবেন না, রাস্তায় সাইকেল বা  মোটরসাইকেলের ওপর থাকলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করুন।

৩. যদি খোলা মাঠ বা খোলা জমিতে থাকেন, তবে লক্ষ্য করুন তার টানা কোনো বৈদ্যুতিক খুঁটি আছে কিনা। যদি থাকে তবে দুই খুঁটির মাঝখানে তারের নিচে পায়ের পাতা উঁচু করে পাতার ওপর মাথা নিচু করে বসে থাকুন।

৪. বজ্রাহত কোনো ব্যক্তিকে কখনো খালি হাতে স্পর্শ করবেন না, কারণ তার শরীরে তখনো বিদ্যুৎ থাকতে পারে।

৫. পাকাবাড়িতে আশ্রয় বেশি নিরাপদ। গাড়ির ভিতরও আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। গাছের নিচে, টেলিফোনের খুঁটির পাশে বা বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের খাম্বার পাশে দাঁড়ানো মোটেই নিরাপদ নয়।

৬. পানির সংস্পর্শে মোটেই যাওয়া যাবে না। বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার আগেই তা মাটি স্পর্শ করে। সোজাসুজি মানুষের গায়ে পড়লে মৃত্যু অবধারিত। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করাও বিপজ্জনক। শুকনা কাঠ দিয়ে ধাক্কা দিতে হবে।

৭. বজ্রপাতের সম্ভাবনা আবহাওয়া বিভাগের রাডারে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘নাউকাস্টনিং’ পদ্ধতিতে মিডিয়াতে প্রচার করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ স্থানে যেতে পারে। এতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।

৮. কোনো কর্ডযুক্ত ফোন ব্যবহার করবেন না। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত ধাতব পদার্থে হাত বা হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন না। বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত পানির ফোয়ারায় গোসল করবেন না। মরা কিংবা পচন ধরা গাছ ও খুঁটি কেটে ফেলুন।

৯. বাসা, অফিস কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হলে বিদ্যুতের সব সুইজ বন্ধ রাখুন, দরজা-জানালা ভালোমতো বন্ধ রাখুন। এ সময় সতর্ক করার আরেকটি কারণ হচ্ছে- এপ্রিল, মে, জুন এই তিনমাস আমাদের দেশে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা বেশি থাকে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই