" ২০৩৮ সাল। বেশ ক"দিন ধরে শরীর ভালো নেই। ডাক্তার দেখানো দরকার। ছেলে, মেয়ে দুজনেই প্রতিষ্ঠিত।তারা দু'জনেই শহরে থাকে। আমি আর আমার স্ত্রী গ্রামে থাকি। ছেলে, মেয়ে আমাদের যথাযথ যত্ন নেয়। তাদের সাথে থাকতে বলে, ইচ্ছে করে না। সারা জীবন কাটিয়েছি গ্রামে।শহুরে জীবন ভালো লাগে না।
যা হোক, আমি, আমার স্ত্রী আর গৃহকর্মী মনির'কে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে শহরে যাত্রা করলাম।পথিমধ্যে এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে দেখা।তিনিও শহরে যাচ্ছেন।স্যার কেমন আছেন?বলে একটি ছেলে হঠাৎ পা ধরে সালাম করলো। বললাম, ভালো। ইদানিং চোখে ঝাপসা দেখছি। বললাম, কে আলাউদ্দীন না? হ্যাঁ স্যার। আসেন, আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসি।পাশে চেয়ারম্যান, আমরা হাটছি।
গাড়িতে ভীষণ ভীড়।দাড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। গাড়িতে উঠে নেমে যাচ্ছি.. পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো, স্যার, স্যার আসেন।সিট আছে। সারা জীবন স্যার ডাকটা শুনতে শুনতে স্যার শব্দটা শুধু নিজের মনে হয়।স্যার শব্দটা শুনলেই এদিক ওদিক দেখি! এখনও থাকালাম। সত্যিই আমাকেই তো ডাকছে! দেখি জামাল আর ফরিদ ইতিমধ্যে তাদের সিট ছেড়ে দিয়ে আমরা স্বামী, স্ত্রী দু'জনের জন্য কী সুন্দর আয়োজন করে ফেলেছে। দাড়ানো মানুষগুলোকে দু'দিকে সড়িয়ে দিয়ে আমাদের নিরাপদ প্রবেশ পথ করে ফেলেছে! সিটে বসে দু'চোখে পানি এসে গেল।
মেডিকেল রোডের একটা ডায়াগোনেষ্টিক সেন্টারের ওয়েটিং রুমে বসে আছি প্রখ্যাত ডাক্তার সৌভিক বড়ুয়া'কে দেখানোর জন্য। আসার ঝক্কিঝামেলার কারণে শরীর বেশ ক্লান্ত। ইতিমধ্যে ছেলেটাও এসেছে। আমার সিরিয়াল নং ২৩। হঠাৎ ডাক্তারের রুম থেকে একজন বের হয়ে বললেন, আপনার নাম কী বিজয় বড়ুয়া।বললাম ,হ্যাঁ। স্যার আপনাকে ডাকছে। রুমে ঢোকামাত্র অতি সুদর্শন মাঝবয়সি একছেলে আমার কদমবুসি করে, জড়িয়ে ধরে অতি বিনয়ের সাথে জানতে চাইলো, স্যার আমাকে চিনেছেন? আমি হ্যাঁ, নার মাঝামাঝি মাথা নাড়লাম। আমি আসলে চিনতে পারিনি। তিনি বললেন, আমি সৌভিক। সৌভিক বড়ুয়া।বললাম, তুমি, তুমি সৌভিক। তুমি তো ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমাদের স্কুলে পড়ে ছিলে, ঠিক না? হ্যাঁ স্যার। আমি দেখছি, আমাদের এ অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী'র চোখ টলটল করছে। বললাম, তুমি আমাকে কীভাবে দেখেছো? স্যার সিসিটিভিতে। তার নির্দেশনায় তার হেলপার আমার সমস্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। হয়তো তিনি ভাবছেন, তার বিখ্যাত স্যারের কাছে তার অখ্যাত স্যারের কত মূল্য!
রাত ৯টা। মুরাদপুর। একটা রিকশার ধাক্কায় চোখ থেকে চশমা টা পড়ে গেলো। কিছুই ভালোভাবে দেখছি না। চশমা টা নিচ থেকে আমার স্ত্রী তোলার আগেই একটা দিনমজুর টাইপের ছেলে পা ধরে সালাম করে বললো, কোথায় এসেছেন স্যার? স্ত্রী বললো, ডাক্তার দেখাতে। স্যার কোথায় যাবেন বলেন, আমি দিয়ে আসবো। আমি এখন ফ্রি। আমার ছেলে বললো, লাগবে না। খেয়াল করলাম, এবার ছেলেটাই কাঁদছে! তার মাথায় হাত বোলাতেই, সে আরো বেশি হুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
এখন ছেলের বাসায়। স্ত্রী'কে বললাম, ছেলেগুলোর জন্য বেশ খারাপ লাগছে। সে বললো, আমি তোমাকে সারাজীবন বলে এসেছি, মাষ্টার হয়ে কী করেছো? এসব সম্মান দিয়ে সংসার চলে না! আজ আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি।"
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার এ ঘুমের স্বপ্ন'টি প্রায় সকল শিক্ষক জাগরিত অবস্থায় দেখেন। তাদের স্বপ্ন এটুকুই।
হে সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্রযন্ত্র, আসুন এসকল সুশিক্ষিত সমাজ বির্ণিমানের কারিগরদের আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করি।
সোনালীনিউজ/এইচএন