‘টাকা দিলে যা কইবেন তাই কইরা দিমু’

  • ফেসবুক থেকে ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০১৭, ০৫:২৮ পিএম

ঢাকা: কম্পিউটার প্রোগ্রামার, সদরঘাটের কুলি অথবা একজন হিজড়া- সবাই চান সামাজিক-অর্থনৈতিক-চিকিৎসার নিশ্চয়তা। কিন্তু এসব নিশ্চয়তা না পেলে- কুলি হন খুনী, ইঞ্জিনিয়ার হন হ্যাকার, এক্সিকিউটিভ হন ইয়াবা বিক্রেতা আর হিজড়া হয়ে যান ভিক্ষুক কিংবা চাঁদাবাজ। অথচ যারা হতে পারতেন এ দেশের অহঙ্কার।
 
এরকম একজন ভাড়াটে খুনির কথা তুলে ধরেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। যে খুনী একসময় ছিলেন অটোমোবাইল মেকানিক। 

বুধবার (১৬ আগস্ট) ফেসবুকে দেয়া Sunny Sanwar -এর সেই স্ট্যাটাসটি সোনালীনিউজের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো: 

‘৩ দিনের রিমান্ড। প্রথম দিনেই সে অসুস্থ হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ পুরাই ভেস্তে গেল। তাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি লেগে গেল।
হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার জানাল যে, সে ভাণ ধরেছিল। তার নাকি কিছু হয়নি। কথাটা শুনে একটু স্বস্তি পেলাম। আবার একটু রাগান্বিতও হলাম।

- কি রে, খুব চালাকি করলি, না?

- না স্যার, চালাকি না। শরীরডা আসলেই খারাপ লাগতাছিল। আর জীবনে কোনদিন এরেস্ট অইনাই তো, তাই।

যাহোক, একটা দিন পুরোই নষ্ট হল। জিজ্ঞাসাবাদের মুডে আর কেউ নেই। সবাই খুব বিরক্ত। কিছুটা ভয়ও পেয়েছে সবাই – যদি আসামির কিছু হয়ে যেত। পরিশেষে আসামি লক-আপে রেখে সেদিনের মত আমরা সবাই বাসায় ফিরে গেলাম। পরেরদিন আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। তাকে একটা চেয়ারে বসতে বলা হল, কিন্তু সে ফ্লোরেই বসবে। সেখানেই নাকি বেশ আরাম।

- তোর সাথে আর কে কে ছিল?

- কোথায় স্যার?

- খুন করার সময়।

- অহ, কাম উঠানোর টাইমে?

- হুম

- ৪ জন স্যার।

- কত পাইলি?

- ৫ হাজার অগ্রীম, কাম অইলে পরে আরও ৮০ হাজার দেয়ার কথা আচিল। হেই ট্যাহা পাওনের আগেই তো উঠাইয়া নিয়া অ্যাইলেন।

- তা তোর ভাগে মোট কত থাকত?

- যেডা পাই নাই হেইডা কইয়া আর কি লাভ!

- তারপরও শুনি। তোর রেট কেমন সেটা বুঝি।

- ৩৫ পাইতাম আমি। অস্ত্রের ভাড়াসহ।

- এত অল্প টাকায় মানুষ খুন?

- এইডা তো খুন না, কাম। যা কইবেন তাই করমু। খুন কইলে খুনই সই। টাকা দিলে যা কইবেন তাই কইরা দিমু।

- তুই আসলে কি করিস?

- আমি অটোমোবাইল মেকানিক। অবৈধ জায়গায় গ্যারেজ ছিল। কর্তৃপক্ষ ভেঙ্গে দিয়েছে। ৯ মাস ধরে বেকার।

খবর নিয়ে জানলাম তার কথা ঠিক। খুব ভাল চলত গ্যারেজটা।

আবাক চোখে আমরা দেখি একটি খুন, আর তার কাছে এটা রোজগারের পথ। তার দরকার কিছু টাকা, আর কাস্টমারের দরকার খুন। এই টাকা দিয়ে যদি কেউ বলে কাউকে একটা ফুল দিয়ে আসতে হবে, তাহলে সে তা-ই দিবে। যদি বলে খুন করতে হবে, তাহলে তা-ই করবে। টাকার বিনিমিয়ে কাজ। কাজের টাইপ কাস্টমার ঠিক কিরে দেয়। কাস্টমার যদি বলে ১ মাস শুধু ঘরে শুয়ে ঘুমাবি, পাবি ২৫। তাহলে তা-ই সই।

আমরা সবাই টাকার বিনিময়েই কাজ করি। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত চাহিদা, যোগ্যতা, সততা, মানবিকবোধ এবং সামাজিক অবস্থানের বিচারে আমরা আমাদের রোজগারের পথ বেছে নেই। আর এই বাছাবাছির উপরই জেল-ফাঁস, পুরষ্কার-তিরস্কার নির্ভর করে।

তাই নিজ পেশা নির্ধারণের কৌশল জানাটা সবার জন্যই খুব জরুরী। তা না হলে ৩৫ হাজার টাকার একটা কাজের আউটকাম হিসেবে একটা খুন এবং একটা ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন জেল খুব বেশী এক্সপেন্সিভ হয়ে যায়। এতে বাদী-বিবাদী কোন পক্ষেরই লাভ হয় না।

একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, সদরঘাটের একজন কুলি, কোন একটি প্রতিষ্ঠানের একজন এক্সিকিউটিভ, একজন হিজড়া সবাই সামাজিক-অর্থনৈতিক-চিকিৎসার নিরাপত্তা বা নিশ্চয়তা চায়। এটা না পেলে কুলি হয় খুনী, ইঞ্জিনিয়ার হয় হ্যাকার, এক্সিকিউটিভ বেচে ইয়াবা, হিজড়ারা হয় ভিক্ষুক কিংবা চাঁদাবাজ। অথচ যারা হতে পারত দেশের অহঙ্কার তাদের আবাস হয়ে যাচ্ছে কাশিমপুর কারাগার। ছোট্ট ভুলে, প্রচন্ড আবেগে, অভাবে, সুযোগে যারা অপরাধী হয়, তাদের জন্য শুধুই পুলিশিং একমাত্র নিরাময় পদ্ধতি হলে দেশে গাণিতিক হারে শুধু জেলখানা বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে আরও বৃদ্ধি পাবে অসংখ্য ভঙ্গুর পরিবার।

যে জাতি একশ বছর আগে রেডিও বানিয়েছে, গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছে তারা আজ মোবাইলের একটা চার্জারও বানাতে পারছে না। মেধা এবং পেশাকে লালন করা গেলে সেই অটোমোবাইল মেকানিকও হয়তো আজ প্রিজন ভ্যানের যাত্রী না হয়ে নতুন মডেলের প্রিজন ভ্যান বানানোর চেষ্টা করত।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেএ