মাশরাফিকে সেই চিকিৎসক

আমিও আপনার মত খেলি তবে মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা

  • ক্রীড়া প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১, ২০১৯, ০৬:৪১ পিএম

ঢাকা : ক্রিকেট মাঠের বাইরে মাশরাফি বিন মুর্তজা একজন সংসদ সদস্য। আর একজন সংসদ সদস্য হিসেবে গত বৃহস্পতিবার নিজ এলাকার তত্ত্বাবধানে নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে যান মাশরাফি। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের কাছে নানা সমস্যার কথাসহ হাসপাতালের অসংখ্য অসঙ্গতি, নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দেখতে পান। রোগী সেজে এক চিকিৎসককে ফোন করেন মাশরাফি। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভিডিও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রতিবেদন হয়।

এর জন্য মাশরাফির প্রশংসিত হচ্ছেন সর্বমহলে। এ নিয়ে ফেসবুকে বইছে প্রশংসার ঝড়। যে যার মতো করে তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন সবাই।

মাশরাফির অনুরোধেই সেই চার চিকিৎসকের শাস্তি স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন বরখাস্ত হওয়া চিকিৎসক শামছুল আলম।

তার লেখাটি সোনালীনিউজ-এর পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

মাশরাফি সাহেব যখন আমাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চুপ করে আছেন, কথা বলছেন না কেন?

ফাইজলামি করছেন? চুপ করেছিলাম কারণ আমি ভাবছিলাম, আমি হয়তো বলতে পারতাম, আপনার হাসপাতালে রোগী অজ্ঞান করার কোন ডাক্তার নেই, থাকলেও অপারেশন টেবিলের লাইট কাজ করে না, সেলাই করার জন্য সুতা পাওয়া যায় না, কর্মচারীরা গোপনে সবকিছু বাইরে বিক্রি করে দেয় .কত কথা বলতে পারতাম কিন্তু না, আমি কিছুই বলিনি।আমি আসলে ভাবছিলাম।

ভাবছিলাম মায়ের কথা, রোগীর লোকজনও দুর্ব্যবহার করলে আমি মায়ের কথাই ভাবি কারণ আমার মা চেয়েছিলেন আমি ডাক্তার হই, বড় হয়ে সার্জন হই। আমি যখন অনেক ছোট, সে সময়, মায়ের গলায় থাইরয়েড ক্যানসার হয়েছিল, এলাকার ডাক্তার বলেছিলেন, মা আর বেশিদিন বাঁচবেন না, ভালো মন্দ যা খেতে চায় কিনে দিতে। কিন্তু বাবা আমার হাল ছেড়ে দেন নি। জায়গা-জমি বিক্রি করে, মাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা শহরের বড় সার্জন দেখাতে। মায়ের অপারেশন হলো, মা বেঁচে গেলেন। আল্লাহ আমাদের মাকে আরো কিছুদিনের জন্য ফিরিয়ে দিলেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের এক কথা, আমাকে বড় হয়ে ডাক্তার হতে হবে, বড় সার্জন হতে হবে।

তারপর শুরু হলো আমার জীবন যুদ্ধ, পাড়ার ছেলেরা যখন ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত সেই সময়ে আমি মন ভরে খেলতে পারিনি, আমার জীবন অন্য জীবন। অবশেষে একদিন ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলাম। এনাটমি ফাইনাল পরীক্ষায় সঠিক করে মূত্রনালির রক্ত চলাচল বলতে পারিনি বলে ফেল করলাম। জীবনে আমার প্রথম সাপ্লি, সবকিছু আবার শুরু থেকে পড়ো, সে কি কষ্ট, যে জানে শুধু সেই বুঝবে কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেইনি।

একদিন ডাক্তারি পাশ করলাম, ট্রেনিং শেষ করলাম, এফ সি পি এস পাশ করে সার্জন হলাম। এই পর্যন্ত আসতে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছে দীর্ঘ পনের বছর। এফসিপিএস প্রথম পর্ব পরীক্ষার সময় আমার বড় মেয়ের জন্ম হলো, কিন্তু আমি পাশে থাকতে পারিনি। দ্বিতীয় পর্বের সময় বউ জন্ডিসে অসুস্থ হলো। বাচ্চা দুইটা অসুস্থ মাকে সব সময় বিছানায় দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো। সারাক্ষণ বাবার পথ চেয়ে বসে থাকতো কিন্তু আমার সময় ছিল না।

আমাদের আবেগকে অনেক সময় বিসর্জন দিতে হয়। চুপ করে থাকতে হয়। সার্জারি ট্রেনিং এর সময় একদিন একটা অপারেশন করার সময় হঠাৎ আমার ছুরিটা একটু ঘুরে গিয়ে রোগীর একটা রক্তনালী কেটে গিয়েছিলো, তাই দেখে আমার স্যার প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন, আমার হাতে একটা যন্ত্র দিয়ে আঘাত করে বলেছিলেন, ছাগল কোথাকার, এইভাবে কেউ ছুরি ঘুরায়? আর একটু হলেতো রোগিই মারা যেত।

তারপর অপারেশন শেষে স্যার আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, কিরে! বকা দিয়েছি বলে মন খারাপ করেছিস? আমি চুপ করে ছিলাম, কি করবো, চুপ করে থাকাই আমার স্বভাব। তারপর স্যার বললেন, তবে যেভাবে তুই মাথা ঠান্ডা রেখে আর্টারি ফোরসেফ দিয়ে ব্লিডিংটা বন্ধ করলি, সেটা দেখার মত ছিল, ব্রাভো মাই সন।

সেদিন আমি জেনেছিলাম, কথায় কেউ বড় হয়না, মানুষ বড় হয় কাজে। এমপি সাহেব, আপনি রাগ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে আমি কি করবো? আমার জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না, আল্লাহ চাইলে আমাকেও আপনার মত একটা ছোট বলের পিছনে দৌড়ে জীবনটা শেষ করতে হতো কিন্তু সেটা তিনি চান নি। তিনি চাইলে আমিও মানুষের রাজা হতাম, মনিব হতাম, চার পাশে হাজারো ক্রীতদাস নিয়ে ঘুরতাম কিন্তু আমার মা, আল্লাহর কাছে সেটা চায় নি। আমিও আপনার মত খেলি তবে মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা। এই খেলায় হতাশার কোন সুযোগ নেই, এখানে হার-জিত বলে কিছু নেই। এখানে পুরোটাই শুধু পুন্য, এই কারণেই আমাদের পথ কখনো শেষ হয় না। একটা কথা বলে রাখি আপনি, আমার কিংবা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন না কারণ মানুষ তার নিজের গল্প শুধু নিজেই লিখে না।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ এপ্রিল নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে যান স্থানীয় সাংসদ মাশরাফি। বিনাছুটিতে চার চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকায় চিকিৎসককে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। এর পর গেল সোমবার তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে মাশরাফির অনুরোধে তাদের দায়িত্বে বহাল রাখা হয়েছে।

এ ঘটনায় চিকিৎসক সমাজ এবং সমাজের নানা পর্যায়ে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এনিয়ে ডা. আবদুন নূর তুষার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লেখেন- মেরুদণ্ডহীন চিকিৎসক সমাজকে ওএসডি করা যত সহজ, রোগীর জন্য সেবা নিশ্চিত করা তত সহজ নয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই