বাসা থেকে মদপান করে যান পরীমণি, বোট ক্লাবে সবাই ছিলেন মাতাল

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১, ২০২১, ০৯:১২ পিএম

ঢাকা: ঢাকা বোট ক্লাবে হত্যা ও ধর্ষণচেষ্টা নিয়ে নায়িকা পরীমনি যেসব কথা বলেছেন, তার সব সত্য নয়, অনেক কিছুই বানোয়াট। মামলার আসামি ক্লাবের সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ এবং পরীমনির সঙ্গী অমির বক্তব্যেও গরমিল পাওয়া গেছে। সেই রাতে তারা সবাই অতিরিক্ত মদপান করেছিলেন। তাই কে কী করেছেন, তার সঠিক চিত্র তারা নিজেরাও ঠিকমতো বলতে পারেননি। পরীমনির সঙ্গী অমি পরদিন ক্লাবে গিয়ে মদের বিল বাবদ লক্ষাধিক টাকা দেন।

সাভার থানায় পরীমনির করা ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।

সাংবাদিকদের তারা জানান, বাদী ও আসামিরা একে অপরের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলেছেন, তার কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা। কেউই পুরোপুরি সত্য বলছেন না। এ ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে, যাদের সঙ্গে পরীমনি ও নাসির উভয়েরই দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের কারসাজিতেই বোট ক্লাবে সেই অনকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তের মূল উদ্দেশ্য পরীমনির অভিযোগের সত্যতা উদঘাটন। তাই তৃতীয় পক্ষকে সামনে আনতে বা তদন্তের অগ্রগতি এখনই খোলাসা করতে চান না তারা।

ঢাকাই চলচ্চিত্রের আলোচিত অভিনেত্রী পরীমনি ১৩ জুন রাতে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, ঢাকা বোট ক্লাবে ৯ জুন রাতে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয়। এ অভিযোগে সাভার থানায় করা মামলায় ১৪ জুন গ্রেপ্তার করা হয় নাসির ও তার সহযোগী অমিকে। তাদের মধ্যে নাসির জামিন পেয়েছেন সম্প্রতি।

কী ঘটেছিল সেই রাতে:

সেই রাতে ঢাকা বোট ক্লাবে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পরীমনির সঙ্গে সেদিন তিনজন ছিলেন। তাদের একজন ব্যবসায়ী অমি। অপর দুজনের একজন তার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ করিম জিমি; অপরজন সম্পর্কে তার বোন বনি। ক্লাবের দোতলায় বসার সময় জিমির ড্রেস কোড নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। জিমি শর্ট প্যান্ট, গেঞ্জি ও স্যান্ডেল পরা ছিলেন।

তারা জানান, মামলার পর থেকেই দফায় দফায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তারা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নিয়েছেন। বাদীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ঢাকা বোট ক্লাবের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণ করেছেন।

এ সব তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, সেই রাতে পরীমনি ও তার তিন সঙ্গী এবং অভিযুক্তদের সবাই ছিলেন মদ্যপ। অতিরিক্ত মদপান করে কে কী করেছেন, তার সঠিক চিত্র তারা নিজেরাও ঠিকমতো বলতে পারেননি। প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ১২-১৪ জন। তাদের মধ্যে যারা মদপান করেননি, মানে স্বাভাবিক ছিলেন, তাদের কাছ থেকে সেই রাতের প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

কর্মকর্তারা জানান, পরীমনি ক্লাবে আমন্ত্রিত ছিলেন না। গাড়ি নিয়ে অমির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সেই ক্লাবে ঢোকেন। সেখানে গিয়ে ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। নাসিরের সঙ্গে তার দেখা ও কথা হয়। সঙ্গীদের নিয়ে তিনি দুই বোতল মদপান করেন।

পরীমনি আরও দুই বোতল দামি মদ জোর করে নেয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়েই ঝগড়া শুরু পরীমনি ও নাসিরের। প্রথমে ধমকাধমকি। তারপর পরীমনিকে চড়-থাপ্পড় মারেন নাসির। অমি নিজেই পরদিন গিয়ে আগের রাতের বিল হিসাবে লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করেন ক্লাবের মেম্বার হিসেবে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পরীমনি ছিলেন অস্বাভাবিক। তিনি বনানীর বাসা থেকে এক দফা মদপান করেই গিয়েছিলেন সাভারের সেই বোট ক্লাবে। সেখানে দুই বোতল শেষ করার পর আরও দুই বোতল দামি বিদেশি মদ নিতে চাইলে নাসিরের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়।

এর জের ধরে পরীমনিকে থাপ্পড় মারেন নাসির। তার দেখাদেখি ক্লাবে উপস্থিত আরেক ব্যক্তি পরীমনি ও তার সঙ্গীদের মারধর করেন। একে তো মদের নেশা, তার ওপর দুজনের মারধরে পরীমনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর সঙ্গীরা ধরাধরি করে তাকে গাড়িতে নিয়ে যান।

তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্য, হত্যা ও ধর্ষণচেষ্টা নিয়ে পরীমনি যেসব কথা বলেছেন, তার সব সত্য নয়। 

এ বিষয়ে পরীমনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্যামেরার সামনে যেসব কথা বলা সম্ভব হয় নাই, সেগুলো পুলিশের কাছে গিয়ে বলেছি। সেই রাতে কী কী ঘটেছিল, তার বিস্তারিত বলেছি।’

তার দাবি, নাসির তার মোবাইল ফোন দিয়ে সেদিন ভিডিও করেন। ফোনটি পরীক্ষা করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।প্রয়োজনে আবারও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন পরীমনি।

পরীমনি জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে সকাল-বিকেল ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন তিনি। কারও কারও ‘জেলাসির’ কারণে তাকে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালের চেষ্টা চলছে। সব খুলে বলতে প্রয়োজনে আবারও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন।

পরীমনির সঙ্গী অমি পরদিন লক্ষাধিক টাকার মদের বিল দিয়েছিলেন কি না, তা জানতে বৃহস্পতিবার ঢাকা বোট ক্লাবের নির্বাহী সদস্য বখতিয়ার আহমেদ খান বলেন, ‘পুলিশ যেটা বের করেছে, সেটা সত্যিই কারেক্ট। এটা ফেয়ার ইনকোয়ারি। তবে এর বেশি কিছু এখন আমি বলতে পারব না। করোনার কারণে এখন ক্লাব বন্ধ। ক্লাব খুললে দেখে নিশ্চিত করতে পারব।’

গত ১৪ জুন গ্রেপ্তার হওয়ার আগে নাসির গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তিনি ক্লাব থেকে বের হওয়ার সময় পরীমনিসহ চারজনকে ঢুকতে দেখেন। তখন তাদের কারও ভারসাম্য ছিল না। তারা কাউন্টারে গিয়ে অনেক দামি ড্রিংস জোর করে নিতে চাচ্ছিলেন।

নাসির বলেন, ‘আমি তাদের বলি, এটা নেয়া যাবে না। নিতে হলে ক্লাবের সদস্য হতে হবে। তা ছাড়া তখন আমাদের বারও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাধা দেয়ায় পরীমনি আমাকে হেনস্তা করেন।’

সেদিনের ঘটনার সূত্রপাত কী নিয়ে, তা জানতে চাইলে পরীমনির সঙ্গী জিমি বলেন, ‘প্রথমেই তারা আমার ড্রেস কোড নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। আমার গায়ে গেঞ্জি, পায়ে স্যান্ডেল ছিল। এটা নিয়েই আপত্তি ছিল তাদের। এরপর আমরা ক্লাবে বসি।’

হাতাহাতি-মারধরের ঘটনা কীভাবে ঘটল, জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। মদের বিল প্রসঙ্গে কিছু জানেন না বলেও দাবি করেন জিমি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘লিখিত অভিযোগে অনেক অসংগতিমূলক তথ্য থাকায় ঘটনার কয়েক দিন পর পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা। তাকে পরিষ্কার করে বলা হয়, তিনি ঘটনাস্থলে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন কি না। তখন পরীমনি বলেন, না।’

পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, পরীমনিকে যে ব্যক্তি বেশি মারধর করেছেন, তার নাম এজাহারে দেননি তিনি। সেই সময় তার নাম মনে ছিল না বলে জানিয়েছেন পরীমনি। যেখানে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে একটি বার ও একটি কার্ড খেলার টেবিল ছিল। আর কোনো রুম ছিল না।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা বাদী, সব আসামি ও প্রত্যক্ষদর্শীর সব বক্তব্য শুনেছেন। রেকর্ড করেছেন। সেগুলো বিশ্লেষণ করে তাদের মনে হয়েছে, ঘটনার নেপথ্যে তৃতীয় পক্ষের সংশ্লিষ্টতা আছে।

তৃতীয় পক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি মনে হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, পরীমনি হাই প্রোফাইল লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। একইভাবে নাসির ছিলেন উত্তরা ক্লাবের তিনবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ক্লাবের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের হাত থাকতে পারে ঘটনায়।

পরীমনির দাবি, নাসির তার নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে সেই রাতের ঘটনা ভিডিও করেন। সেটি উদ্ধার করে পরীক্ষা করলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নাসিরের সেই ফোনটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে আছে। পরীক্ষাও করা হচ্ছে।

তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘মামলার তদন্তের স্বার্থে যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করা দরকার সবই করেছি। কী পেয়েছি, না পেয়েছি তা প্রকাশ করা সমীচীন নয়।’

পরীমনি ও নাসিরের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপসহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’

সূত্র-নিউজবাংলা২৪

সোনালীনিউজ/আইএ