রাজ্যে রাজ্যে বিক্ষোভে উত্তাল ভারত

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯, ০২:৫৬ পিএম

ঢাকা : অমুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদানে পাস হওয়া একটি বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয় রাজ্য। নিহত হয়েছেন পাঁচজন।

কারফিউ জারিসহ মোতায়েন করা হয়েছে সেনা। সফল বাতিল করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রীসহ বাংলাদেশের দুই মন্ত্রী। সর্বশেষ শিলং সফর বাতিল করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

বিক্ষোভ সবচেয়ে জোড়ালো আসামে। নিহত পাঁচজনের সবাই ওই রাজ্যটির। এদিকে গতকাল থেকে উত্তরপূর্ব ভারতের আরেক রাজ্য মেঘালয়ও উত্তাল। শিলংয়ে কারফিউ জারিসহ ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।

এদিকে শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বিক্ষোভ উত্তাল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের দিল্লি সফর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মেঘালয় সফর গতকাল শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। তিন দিনের সফরে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের আজ শুক্রবার সড়কপথে মেঘালয় যাওয়ার কথা ছিল।

সফরসূচি অনুযায়ী আসাম রাজ্যের রাজধানী গোহাটিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল জাপানের প্রধানমন্ত্রীর। গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১৫ থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মোদি-শিনজোর বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাও বাতিল করা হয়।

এদিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে কারফিউ জারির কারণে সিলেটের তামাবিল দিয়ে ভ্রমণকারীদের যাতায়াত সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় আটজন বাংলাদেশি সীমান্ত পার হতে গেলে ভারতের ডাউকি থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। আন্দোলন চলছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) নিয়ে উত্তরপূর্ব ভারত অগ্নিগর্ভ রুপ ধারণ করায় অমিত শাহের শিলং সফর বাতিল করা হয়। আগামী রোববার নর্থ-ইস্ট পুলিশ অ্যাকাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতির। ওই সফরের পর তার অরুণাচল রাজ্যের সফরও বাতিল করা হয়েছে।

বিতর্কিত ওই নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে উত্তাল ভারতের উত্তরপূর্বের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিসেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মেঘালয়ে ১২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নিলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে রাজ্য ভবনের কাছে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়লে সংঘর্ষ বেধে যায়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আশ্বাস-অনুরোধ সত্ত্বেও আসামে আগুন জ্বলছে। বিক্ষোভ সামাল দিতে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। জারি করা হয়েছে কারফিউ। সবকিছু অগ্রাহ্য করে রাজ্যটির শহরে শহরে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। আগুন জ্বেলে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আইনের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা।

আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখ এক এমপির বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে চারটি রেলস্টেশন ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের একটা কার্যালয়। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছেন পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। পাঁচজন নিহত হওয়ার ছাড়াও আহত হয়েছেন আরও অনেকে।

আইনের বিরোধিতায় পশ্চিমবঙ্গেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। কলকাতা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, বহরমপুরসহ বিভিন্ন স্থানে রেললাইন ও জাতীয় সড়ক অবরোধ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাস্তায় নেমে গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

হাওড়া থেকে দক্ষিণ ভারতগামী দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। হাওড়ায় ফেরার পথেও আটকে আছে একাধিক দূরপাল্লার ট্রেন। স্থানীয় ট্রেন চলাচলও বন্ধ। রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। পাথর ছুড়ে হামলা চালানো হচ্ছে আটকে থাকা ট্রেনগুলোতে।

উত্তরপূর্বের রাজ্য মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। বিক্ষোভকারীরা বাঙালি অধ্যূষিত এলাকায় ভাঙচুর চালিয়েছেন বলেও খবরে জানানো হয়েছে। বিক্ষোভ চলছে ত্রিপুরা আর মণিপুরেও। আসামের পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ১ হাজার বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পার্লামেন্ট ভবন অভিমুখে বিক্ষোভের ডাক দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা শুক্রবার দুপুরে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে বাইরে বের হতে চাইলে পুলিশের তাতে বাধা দিয়ে ৫০ শিক্ষার্থীকে আটক করে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) বিরুদ্ধে সর্বসাধারণকে রাস্তায় নেমে গণআন্দোলন করার ডাক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের দিঘায় সংবাদ সম্মেলন করে আগামী রোববার ও সোমবার ‘নো এনআরসি’ আন্দোলনের কর্মসূচির কথা জানিয়ে নিজে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে মমতা বলেন, আগামী রোববার রাজ্য জুড়ে ব্লকে ব্লকে ‘নো এনআরসি’ স্লোগানে আন্দোলন হবে। সব জেলায় মিছিল করবেন দলের কর্মীরা। বিজেপি বাদে অন্য দলকেও তিনি এ আন্দোলেন শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার কলকাতায় বি আর অম্বেদকরের ভাষ্কর্যের পাদদেশে জমায়েত করবে তৃণমূল কংগ্রেস।

মমতা বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করুন। আমি নিজেও আন্দোলনে যোগ দেব। গায়ের জোরে সিএবি (নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল) পাস করে নিয়েছে তারা (বিজেপি)। কিন্তু বাংলায় এনআরসি করতে দেব না। প্রত্যেক রাজ্যের আলাদা আবেগ আছে, আলাদা বিষয় আছে।’

প্রসঙ্গত, ভারতের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে এই সংশোধনে গত সোমবার ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় একটি বিল (সিএবি) উত্থাপন করনে অমিত শাহ। ব্যাপক বিতর্কের পর সেদিন মধ্যরাতে বিলটি পাস হয়। এরপর গত বুধবার রাজ্যসভাতেও বিলটি পাসের পর রাষ্ট্রপতি গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর করায় সেটি এখন আইন।

নতুন এই আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৫ সালের আগে প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ হয়ে যেসব অমুসলিম (হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা) ভারতে গেছেন তাদেরকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে।

বিরোধী দলের এমপিরা পার্লামেন্টে মোদি সরকারের প্রস্তাবিত এই বিলটিতে আপত্তি জানালেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিলটি পাসে কোনো বেগ পেতে হয়নি সরকারকে। বিরোধীরা বলছেন, নতুন আইনের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের নাগরিক সুরক্ষাকে উপেক্ষা করা হবে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্য আসামসহ উত্তরপূর্ব ভারতে বিক্ষোভকারীদের দাবি, আইনটির মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা সহজেই এ দেশের (ভারতের) নাগরিকত্ব পাবেন। তাতে সংকটে পড়বেন আদি বাসিন্দারা। তবে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, আইনটিতে উত্তরপূর্বের অনেকটা অংশই বাদ দেয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই