ট্রাম্পের ‘কারণে’ যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটন ব্যবসায় ধস

  • শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০১৭, ০৫:২৭ পিএম

ঢাকা: একসঙ্গে অফিসের কাজ ও বিনোদনের সুযোগ থাকায় ডিজনিল্যান্ড, লাস ভেগাস, হলিউড এবং রাতের মন মাতানো ক্যাসিনোর টানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি পর্যটক ভিড় জমান যুক্তরাষ্ট্রে। আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রে হওয়ায় অফিসিয়াল পর্যটকের সংখ্যাও নেহায়ত কম নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই ডিজনিল্যান্ডের মিকি মাউস দেখার লোক নেই। 

খদ্দের সংকটে পড়েছে ক্যাসিনোগুলো। সবচেয়ে বড় ধাক্কা মুসলিম ও এশিয়ার দেশগুলোর পর্যটকদের নিয়ে। সাগর, সমুদ্র সৈকত, সমতল ও চ্যালেঞ্জিং সব রাইডে সমৃদ্ধ দেশটির পর্যটন খাত থেকে আয় কমছে ধারবাহিক হারে।

পর্যটক কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই ১৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশটি। এতে বছর শেষে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাবে, প্রতিবছর পর্যটন খাত থেকে তারা আয় করে ২.১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেড় কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই  খাতে।

চিত্ত হরণকারী এই কাঁচের স্থাপনা না দেখলে বুঝা যায় না। অপরূপ নির্মাণ শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এটি

গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শরণার্থী ও অভিবাসী নিয়ন্ত্রণে দেন একের পর এক বিতর্কিত আদেশ। ফলে অভিবাসী গমনে কড়াকড়ি ও নিরাপত্তার অজুহাতে অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই কয় মাসে পর্যটক কমে গিয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছে দেশটির আর্থিক খাতে। 

ফলে পর্যটন থেকে বিরাট অঙ্কের আয় কমে গিয়েছে দেশটির। আর্থিক লোকসানে পড়েছে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত হোটেল, খাবার, গাইড ও ট্যুরিজম খাতের ব্যবসায়িরা। গড়ে দৈনিক দুই হাজার পর্যটক কমেছে দেশটিতে বলে জরিপ প্রকাশ করেছে বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা।

বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমেছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটন নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ট্যুরিজম ইকনোমিক্স’- ক্ষতির একটি পরিমাণ বের করেছে। প্রাথমিক এক হিসাবে সংস্থাটি বলছে, পর্যটক কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছর শেষে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৪০ কোটি মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

ফ্লাইট চলাচল নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান হপার বলছে, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারিতে ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পর্যটক আসার পরিমাণ উল্লেখজনকহারে হ্রাস পেয়েছে। এ সময় চীন এবং ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ফ্লাইট কমেছে ৪০ শতাংশ। আয়ারল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড থেকে আসা ফ্লাইট কমেছে কমেছে ৩৫ শতাংশ। এতে দৈনিক গড়ে দুই হাজার বিদেশি পর্যটককে হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 

তবে মোট পর্যটকের সংখ্যা হ্রাস পেলেও বিস্ময়করভাবে ট্রাম্পের এ সময়ের রাশিয়া থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গড়পরতা পর্যটকের সংখ্যা যেখানে কমছে সেখানে রাশিয়া থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ।

রাত যত বাড়ে ক্যাসিনোর মায়াবি আকর্ষণে লোকসমাগম আরো বাড়তে থাকে। পর্যটকরা শখের বসেও খেলতে যায় ক্যাসিনোগুলোতে

এমন অবস্থার অবসানে ট্রাম্প প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে আগামী বছর পর্যটক আসার পরিমাণ কমে ৬৩ লাখে দাঁড়াবে বলে গবেষণা সংস্থাটির আশঙ্কা। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১০৮০ কোটি ডলার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফ্লোরিডার মায়ামি, এরপর সানফ্রান্সিসকো ও নিউ ইয়র্ক।

ইউএস ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট জোনাথন গ্রেলা বলেছেন, ৯/১১ এর পর বিদেশিরা আমেরিকাকে নিরাপদ ভাবেননি। এরপর তারা কখনোই যুক্তরাষ্ট্রে এলে হৃদ্যতাপূর্ণ আতিথেয়তা পাননি। এ কারণে গত ১৫ বছরেই পর্যটন শিল্পকে লোকসানের সাগরে হাবুডুবু খেতে হয়েছে। এমন অবস্থায় ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এ খাতকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলেছে।

আন্তর্জাতিক এক সংবাদ মাধ্যমকে দেশটির স্থানীয় এক হোটেলের কর্মকর্তা বলেন, এশিয়ার একটি গ্রুপ তাদের যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছেন। ব্রিটিশের একটি ইয়ুথ গ্রুপের ৪০০ জন আসার কথা ছিল এই গ্রীষ্মে। তিন সপ্তাহ থাকার জন্য বুকিং দিয়েছিল তারা। কিন্তু ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের পর সে ভ্রমণ-পরিকল্পনা বাতিল করেছে তারা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলে বলছে, এরকম ঘটনা অনেক হোটেলের বেলায় ঘটেছে। কিছু পাঁচ তারকা হোটেল পর্যটকদের জন্য রোলেক্স ঘড়ি উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েও পর্যটক টানতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে হুমকির মুখে পড়বে দেশটির পর্যটন খাত।

সমুদ্র বিলাসে পর্যটকরা যবেন না, তা কি হয়, দেশটিতে একরকম বেশকিছু বিখ্যাত পর্যটন স্পট রয়েছে

ভ্রমণ ও বিনোদন একসঙ্গে উপভোগের রাজধানী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এজন্য প্রতি বছর দেশটিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের পর্যটকের সংখ্যা প্রায় গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখের মতো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাভেল এজেন্সির হিসাবে ২০১৬ সালে দেশটিতে ৭ কোটি ৮৬ লাখ পর্যটক গিয়েছিল। তাদের আশা ছিল ২০১৭ সালে ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়ে এই সংখ্যা আট কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর ও উন্নয়ন সহযোগী অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বার্ষিক সভা ও বিভিন্ন সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরিয়ে অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দিয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্মকর্তরা। এই গ্রীষ্মে জাতিসংঘে একটি অনুষ্ঠানে দুইশটি সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে ৫০০ জনের আসার কথা ছিল। কিন্তু সবাই গত সপ্তাহে ওই  কর্মসূচিতে অংশ না নেয়ার কথা জানিয়ে হোটেল বুকিং বাতিলের অনুরোধ করেছেন।

গ্লোবাল বিজনেস ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (জিবিটিএ) এর এক হিসাবে ট্রাম্পের ভ্রমণ বির্তকিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশের ১৭ শতাংশ ফ্লাইট কমেছে। শুধু মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ইরাক, সিরিয়া, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন থেকে কমেছে ৮ শতাংশ ফ্লাইট। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, এই কয়মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ শতাংশ মুসলিম পর্যটক কমে গিয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আতা