‘কত বয়সে প্রেম করা শুরু করেছি, তা বলতে লজ্জাই লাগছে‍‍’

  • সোনালীনিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০১৯, ০৭:৫১ পিএম

ঢাকা : মাকসুদা আক্তার প্রিয়তী। বাংলাদেশী মেয়ে। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান আয়ারল্যান্ডে। পড়াশোনার সঙ্গে জড়ান মডেলিং-এ। নিজের চেষ্টা আর সাধনায় অর্জন করেন মিস আয়ারল্যান্ড হওয়ার গৌরব। নিজের চেষ্টায়ই বিমান চালনা শিখেছেন। ঘর সংসার পেতেছেন আয়ারল্যান্ডেই।

নিজের বেড়ে উঠা, মডেলিং এ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-’প্রিয়তীর আয়নায়’-। বইটিতে নিজের পারিবারিক জীবনের নানা দিকও তুলে ধরেছেন মডেল প্রিয়তী। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো সোনালীনিউজ এর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে প্রথম পর্ব-

আজও মনে আছে সেই তারিখ। বান্ধবীর জন্মদিনের সন্ধ্যায় বান্ধবীর মারফতে জানানো হয় সে আমাকে পছন্দ করে। পরে দুই সপ্তাহ পর ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে অফিসিয়াল প্রপোজ করে সেই ছেলেটি। যেই ছেলেটি পাড়ার সবচেয়ে সুদর্শন, হ্যান্ডসাম ছেলে। আমার কাছে ভালো লাগত। ঠিক কত বয়সে প্রেম করা শুরু করেছি, তা বলতে লজ্জাই লাগছে। তবে স্কুলে থাকতে। এখন ফিরে তাকালে বলি, আল্লাহ আমি কি বাচ্চা ছিলাম, হাহাহা। আমি সিউর আপনাদেরও স্কুলের প্রেমের কথা ভাবলে এমনই মতে হতো। স্কুল ফাঁকি দিয়ে বা অন্য কোনো বাহানা বানিয়ে দেখা হতো আমাদের। তাছাড়া, পাড়ায়ও সে আসত। অন্ধ হয়ে যাই তার প্রেমে। তখনকার বয়সের প্রেম হয়তো এমনই। আজও অনুভব করতে পারি, তার প্রথম হাতের স্পর্শ, আমার প্রথম প্রেমের স্পর্শ। ওইদিন প্রথম কোনো ছেলে আমার হাত ধরেছিল। বেশ কিছুক্ষণ হাত ধরে বসেছিল ছেলেটি। এটা একটা অদ্ভুত শিহরণ। হাত ধরার পরপরই পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল। মনে হয় নীরব শান্ত দীঘিতে কেউ বুঝি আজ ঢিল ছুঁড়েছে। একটা তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে যেন আমার ভেতর দিয়ে। আমি সে তরঙ্গটা একই সাথে অনুভব করতে পারছি আবার একই সাথে মিলিয়েও যাচ্ছে! আমি অনেকদিন সেই অনুভূতি নিয়ে পথ চলেছি। এখন অবধি ওই হাত ধরার মতো করে কেউ আমার হাত ধরেনি।

ওইদিন ছেলেটি আমার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। দু’জনের দেখা হওয়ার সবচেয়ে সুন্দর দিনটা ছিল সেদিন। তারপর দেখা হওয়ার ব্যাপারটি ছিল একেকটা পুড়ে যাওয়া ক্ষতের মতো। দগদগে ঘা হয়ে আজও মনের মধ্যে আছে সেসব স্মৃতি। এরপর থেকে প্রায়ই দেখা হতো আমাদের, ওর সাথে দেখা করতে গেলেই মাঝে মধ্যে ঝগড়া হতো। আর ঝগড়া হলে প্রায়ই আমাকে মারধর করত। প্রেমিকার গায়ে কেউ হাত তোলে এটা একটা অনন্য ঘটনা বটে। ওর সঙ্গে প্রেম করে আমি একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলাম। ওটা আমার প্রথম প্রেম। আমার ধারণা ছিল, প্রেম ব্যাপারটি হয়তো এ রকমই। প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মারবে, কাটবে আরও কত কি! মতের মিল না হলে, ওর মতো করে না চললে, ওকে কিছু না বলে কোথাও চলে গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত প্রায়ই। কিন্তু প্রেমেতে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি বিকল্প কিছু ভাবতেই পারতাম না। কী একটা অদ্ভুত নেশায় আমি ওর কাছে ছুটে যেতাম।

ওর সঙ্গে দেখা করে আসার পর মা আমাকে দেখে অবাক হতেন। মন খারাপ করে, ঝিম ধরে আমি হয়তো বাসায় ঢুকলাম। মা বুঝতেন। ‘সামথিং ইজ রং!’

জানতে চাইতেন, কারণ কি? আমি কান্না লুকাতাম। আমার ভেজা চোখের পাপড়িগুলো শুকিয়ে নিয়ে তবেই দাঁড়াতাম মায়ের সামনে। গলার ভেতর থেকে কোনো মতে বের হতো, ‘কিছু না নাম।’

আমি ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতাম না। আমি তো ওকে ছাড়া অচল। কী যে একটা বিনি সুতার টান অনুভব করতাম সেটা একটা কোটি টাকা দামের প্রশ্ন। অবশ্য ওর এই রাগারাগি, ঝগড়া এবং মারামারির পেছনে একটা কারণ ছিল। ও এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছে যেখানে বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করত। এমনকি তার বাবা তার মায়ের গায়ে হাত তুলত। এই অবস্থা দেখে দেখে একটা ছেলে বেড়ে উঠলে আর কি-ই বা শিখবে! বাসায় দেখে আসত বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলছে আর ও এসে ওটাই করার চেষ্টা করত। এ কারণেই একটা সময়ে এটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। মনে হতো, ওর সঙ্গে তো আমার বিয়েই হবে। আর স্বামীর হাতে মার খাওয়া তেমন কিছুই না। তখন তো আমার চিন্তার ব্যাসার্ধ ছিল ওকে ঘিরেই। আর চিন্তা কত দূরেই বা যাবে!

আরেক দিন এইভাবে ওর (প্রেমিকের) সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরি। মা দরজা খুলে দেন। সেদিন আমার প্রচ- মন খারাপ। একটু আগে যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম সে খুব মেরেছে। হাতে-পায়ে দাগ আছে। মারার পর ঠোঁটে একটা গভীর চুমু খেয়েছে। কিন্তু গভীর হোক কি অগভীর চুমুতে নিশ্চয় মারের দাগ মোছা যায় না। আমার দাগও মুছে যায়নি। বরং সময়ের সাথে সাথে তা আরো প্রকট হয়েছে। দগদগে ঘায়ের মতো সেই দাগগুলো বয়ে এনেছি বাসা অবধি।

রাতে ঘুমিয়েছিলাম আমার বোনের পাশে। ভুল বললাম, বোনই আমার পাশে শুয়েছে। এতদিন বাদে আমি বাসায় এসেছি। আমার কাছে এসে শোবে এটাই তো স্বাভাবিক। টুকটাক গল্প করছিলাম। গল্প আর কি? প্রতিবার দেখা হলেই যে গল্পটা আমরা করি। সেটাই। ও জানতে চাইত, আমাদের এই অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন হবে না। ভাইয়েরা কি অত্যাচার আর বাজে কথা বলা বন্ধ করবে না?
আমি ওকে আশা দিতাম। বলতাম, ‘অবশ্যই করবে। সবকিছুরই তো শেষ আছে। বলতাম বটে, কিন্তু নিজেই টিক নিজের কথার ওপর আস্থা পেতাম না। জন্মের পর থেকে দেখা এই যন্ত্রণা হঠাৎ কি এমন দৈবক্রমে চলে যাবে? যেতে পারে? আর গেলেও কীভাবে যাবে সেটা মাথায় আসত না।

কিন্তু ছোট বোনকে তো আশা দিতে হবে। আমাদের সংসার সমুদ্রে ওই আশাটুকুই ছিল একমাত্র ভেলা। তাতেই আমরা সময়ের নিষ্ঠুর ঢেউগুলো একে একে পাড়ি দিতাম।

তো ছোট’র সাথে আমার গল্পের শেষ থাকত না। এই বিষয়ক থেকে সেই বিষয়ে চলে যেতাম। সেদিনও গল্প চলছিল। ছোট এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। আমি উঠে বসি। আমার ওর কথা মনে হয়। সন্ধ্যার কথা মনে হয়। বুকে চেপে থাকা পাথরটার কথা মনে হয়। খুব ইচ্ছা করে নিজেকে কষ্ট দেই। টেবিলের কাপড়ের নিচ থেকে ব্লেড বের করে হাতে বসিয়ে দিলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। অজ্ঞাত কারণে সেদিন কোনো ব্যথাই অনুভব করি না। কী অদ্ভুত! আমি কাটা জায়গাটা ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকি। চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। আমি ভাবতে থাকি ও কেন আজ এ রকম করল। ও কেন আমার ব্যাপারটা বুঝতে চাইল না! কেন? কেন? কাটা হাতের রক্তক্ষরণের চাইতেও অধিক রক্তক্ষরণ আমি অনুভব করতে থাকি আমার বুকের ভেতর।

ঠিক ওই সময় মাথায় একটা হাতের স্পর্শ পাই। আবছা আলোয় বুঝি, মা এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পেছনে ছোট বোন। তখন গলার কাছে আটকে থাকা কান্নাটা গমক দিয়ে ওঠে। হু হু করে কেঁদে ফেলি। আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বোনটা ছুটে যায় স্যাভলন আনতে। একটা নির্ঘুম রাত আমি পার করি, আমরা অসহায় তিনজন নারী। এ রকম যে কত রাত পার করেছি, তার ঠিক নেই।

সম্ভবত এসব কারণেই মা আমার জন্য বিকল্প চিন্তা করলেন। তার ওই টুকুন মেয়েকে দেশের বাইরে পাঠানোর মতো একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। সেদিন রাতেই উনার সেই কঠিন সিদ্ধান্ত আরও দৃঢ় হয় কিনা কে জানে! সেদিন বা যেদিনই নিক, সিদ্ধান্তটা আমার জন্য অন্যরকম। সম্ভবত আনন্দের, আবার কষ্টের।

আর মায়ের কাছে গভীর গোপনীয়তার! 

সোনালীনিউজ/এইচএন