মুক্তগদ্য

আমার কৈফিয়ত : কবি ও অকবি

  • বঙ্গ রাখাল | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২১, ১২:৩৭ পিএম
কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল

ঢাকা : এখনকার কবিরা (কিছু) হয়তো বা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ভুগছেন কিংবা নিজেকে একজন তুপাপানার মত কূলকিনারাহীন ভেবে শঙ্কায় অস্থির জীবন-যাপন করছেন। কি করবেন কিংবা কি করবেন না ভেবে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে উঠেছেন। যে কারণে, নিজেকেও সামলাতে তাদের কষ্ট হয়। সামান্য কিছু হলেই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অন্যকে গাল-মন্দ করেন। আসলে ভাগ্যিস তাদের হাতের কাছে ফেসবুক ছিল। তা না থাকলে হয়তো অবস্থা কেমন হত তা আমি ভেবেও পাই না। তারা হতাশার এক পর্যায়ে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ভাষায় বলতেন- ‘এখানে কোন পানি নেই কেবল পাথর’। কবিদের আমরা বলে থাকি- আদর্শের বা সমাজ বিনির্মাণের কারিগর। তাদের সৃজনশীলতা আমাদের পাথেয়। কিন্তু কোন কবি যখন আদর্শের পরিবর্তে নৈতিকতা হীনের আচরণ করে তখন আপনি তাদের কি বলবেন? তাদের কবিতার কিছুই কি কাজে লাগবে?

হয় তো অনেকে আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন- বলবেন কবির কবিতার সাথে ব্যক্তি জীবনের কি সম্পর্ক রয়েছে। আমরা গ্রহণ করতে চাই তাদের কর্ম। কিন্তু তাদের আমি বলতে চাই- যে মানুষটা ব্যক্তিজীবনে নৈতিকতার  অধিকারী বা আদর্শকে ধারণ করে না-যে জীবন-যাপনে ভণ্ডামিকে ধারণ করে কবি হতে এসেছে তাদের আমরা নিশ্চয় একজন বার্তাবাহক বলতে পারি না। যাদের জীবন-যাপনই ভণ্ডামি দিয়ে, সে কি করে তার সৃজনশীলতা দিয়ে সমাজ বিনির্মাণ করবেন। আগে তো নিজেকে দিয়ে অনুভব করতে হয়। যে কারণে, কবি শব্দটা আজ গালিতে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকে ফ্যাশন হিসেবেও কবি পদবীকে ব্যবহার করে থাকেন। সম্প্রতি দৈনিক খোলা কাগজের সম্পাদকীয় পাতায় আমার আমার একটি লেখা- ‘ঝিনাইদহের কবি ও কবিতা’ (১৯.৭.২০২১) প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই কিছু কবি নামধারী অকবি বিভিন্নভাবে ফেসবুকে পোস্ট বা গাল-মন্দ শুরু করেছেন। কারণ তাদের নাম এই লেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। 

মূলত আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ছিল অনেকদিন ধরে আমি ঝিনাইদহের সন্তান হিসেবে আমার অঞ্চলের বইপত্রের শূন্যতা অনুভব করি এবং এলাকার কে কি লেখছে তাদেরও চেনাজানাটা জরুরী মনে করি। সেই জায়গা থেকেই এই অঞ্চলের বিভিন্ন সূত্র থেকে যারা কবিতা লেখে তাদের নামগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। এইটাই যে ঝিনাইদহ জেলার সমস্ত কবির নাম আসবে সেটাও না। কেননা আমি ঢাকায় থাকার ফলে গ্রামে গ্রামে বা মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে সকল কবিদের নাম সংগ্রহ করাও আমার জন্য বেশ দুরূহ ব্যাপার। আমাদের প্রত্যেকটি জেলার মধ্যে কবি লেখদের মধ্যে গোষ্ঠীবাদিতা বা গ্রুপিং রয়েছে। একজন অন্য জনের নাম বলতেই চান না। কিন্তু নিজেকে একজন মস্ত কবি হিসেবে জাহির করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। নিজেরা তো কোন কাজের কাজ করবে না আবার অন্যরা কাজ করলে তার গোষ্ঠী  উদ্ধার করতেও তারা ছাড়বেন না। আবার যারা অন্য জেলাতেও এই একই সমমনা রয়েছেন তারাও একজোট হয়ে যে কাজ করবে তার বারটা বাজাতে ছাড়বেন না। কারণ তারা মাসতুতো ভাই। কোন কিছু বললেও একজন কষ্ট পাওয়া কবিকে অন্য একজন কবি, সান্ত্বনা দেওয়াকে নাকি নৈতিকতা বলে দাবি তোলেন। কিন্তু বুঝতে পারি না তাদের এত নৈতিকতা কোথায় থাকে। 

যখন শতশত মানুষকে বাকরুদ্ধকর আইন করা হয়, হাজার হাজার মানুষের বাসস্থান বা খাদ্যের ব্যবস্থা হয় না, ব্লগারদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় বা সামান্য লেখার কারণে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসিত হতে হয়, হুমায়ূন আজাদ, শামসুর রাহমানকে আঘাত করা হয়। কোথায় থাকে তখন এই সব উটকো কবি নামের অকবিদের নৈতিকতা। তারা নৈতিকতার জোয়ারে ভাসেন যখন একটা তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ পরে। যারা সংকলন করেন তাদের তো অনেক সীমাবদ্ধতা থেকে থাকে। কারণ তাদের সবাইকে জানা বোঝার ব্যাপারটা তো রয়েই যায়। যে সংকলন বা সম্পাদনা করবে তার পরিচিত মানুষেরা সংকলন বা সম্পাদনায় স্থান পাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। 

আবার সবাইকেই সংকলন বা সম্পাদনায় রাখতে হবেই বা কেনো? কারণ ইতিহাস সব সময় সত্যকে অবলম্বন করেই লেখতে হয়। সেটাই তো অনেক পরিবর্তের মধ্য দিয়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছায়। আর একটা সংকলন বা সম্পাদনা সেতো কিছু কবি বা সময়কে ধরার করার জন্যেই করা হয়। যারা করেন তারা তো ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কেননা তারা যা কিছু করুক না কেন অন্তত কিছু মানুষকে এক জায়গা করতে পেরেছেন। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়- সাতচল্লিশ উত্তর পূর্ববাংলা তরুণ কবিদের প্রথম কাব্য সংকলন-‘নতুন কবিতা’। যা সম্পাদনা করেন আশরাফ সিদ্দিকী ও আব্দুর রশীদ খান। বড় বড় কবিদের সংকলনেও অনেকের নাম তালিকা ভুক্ত হয়নি বা তাদের নাম নেয়। হুমায়ূন আজাদের সংকলনে কবিদের তালিকায় কবি আল মাহমুদ-এর নাম নেয়। তাতে কি এমন লাভ বা ক্ষতি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। আবার আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সংকলনে ফররুখ আহমদের কবিতা রাখি রাখি করেও শেষমেশ তিনি তার কবিতা রাখেননি। 

তাদের কবিত্ব শক্তির কি এমন ক্ষতি হয়েছে। আর আজকে যারা নিজেদের কবি বলে দাবি তুলছেন তাদের নাম সংকলনে না থাকলে তারা একটা স্ট্যান্ডবাজি শুরু করে দেন। তারা বলেন আমরা সংকলন বা তালিকার অমক করি তমক করি তাহলে এতো মাতোয়ারা হওয়ার কি আছে । একজন আবার অন্য জনের শোকে শোকাহীত হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন বা সান্ত্বনার বাণী ছুড়ছেন। খুঁজে চলছেন কে কে কোন কোন জেলায় এমন বাদ পড়া কবি রয়েছে তাদের নিজে আন্দোলনের ডাক দিবেন বলে জোরে সোরে আওয়াজও তুলছেন।  যাই হোক এমন অসংখ্য সংকলন বা সম্পাদনায় নামী দামী অনেক কবিদের নাম নাই -তাতে তাদের কি ক্ষতি হয়েছে। অথচ অঞ্চলভিত্তিক কোন সংকলনে কারও নাম না থাকলে মহাপণ্ডিত কবিরা গালি-গালাজ বা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাদের কবিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। 

আবার তাদের জাত ভাইদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য জুটে যান অন্য সংকলনে আশ্রয়হীন জাত ভায়েরা বা তাদের ভাইরা ভাইয়েরা। তারা আবার গালমন্দ করে তালিকা বা সংকলনকে গালি-গালাজ করে বলে আমরা এসব.... করি না। আসল কথা আঙ্গুর ফল টক। তাদের বলি-ওহে পণ্ডিতমশাই বা জাতির উদ্ধারকারী বিবেক আপনার সৃজনশীলতার বলে আরেকটা সংকলন বা সম্পাদনা করে বাদ পড়া কবিদের যুক্ত করে সাহিত্যের গতিকে আর একটু ত্বরান্বিত করুন। এই সাহিত্যে তো মাস্তানি বা গাল-মন্দ, কাদা ছুড়াছুড়ির তো কোন সুযোগ নাই। আরেকজন কবি যদি অন্যের নিকট নিজেকে চেনাতেই না পারল তার সৃজনশীলতার দ্বারা তাহলে কিসের বলে আমরা তাকে কবি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

সে যদি জেলার কোন উল্লেখযোগ্য কবি হত তাহলে অন্ততপক্ষে জেলার কবিদের কাছে সে পরিচিত থাকত। সাহিত্যের উত্তর হবে সাহিত্যের ভাষায়, শৈল্পিকতায়। এখানে তো কোন হাতাহাতি-হুমকি-ধামকি-গালি-গালাজের স্থান নেই। এটার স্থান পাড়া বা মহল্লায়- সেখানে চেনা যায় বাহুর জোর কার কেমন, রাজনীতি বা ক্যাডারনীতি চলে শক্তির পরীক্ষা... সাহিত্যে নয়... তবুও আশায় বাঁচে মানুষ-রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের সেই অনুভবের মত অকবিদের আস্ফালনের দিকে তাকিয়ে আবার তাদের সুবোধের প্রত্যাশায় বলতেই পারি- ‘জাগিয়া উঠিবে প্রাণ’। 

সোনালীনিউজ/এসএন