শ্রদ্ধার ফুল ও চোখের জলে সমরজিৎ রায় চৌধুরীকে বিদায়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২২, ০৬:৫৭ পিএম

ঢাকা : চিরবিদায় জানানো হলো আদর্শ শিক্ষক ও নন্দিত চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরীকে। শেষশ্রদ্ধা জানাতে সোমবার (১০ অক্টোবর) সকাল সোয়া ১০টায় তাঁর মরদেহ আনা হয় কর্মক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে। অধ্যাপনা থেকে অবসরের পর আবার সেখানে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। 

একসময়ের ছাত্র ও পরে সহকর্মী হওয়া চারুকলার শিক্ষকেরা তাঁদের এই শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক, শিল্পী ও সহকর্মীকে শেষবিদায় জানালেন শ্রদ্ধার ফুল ও চোখের জলে।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর পৌনে ১২টায় সমরজিৎ রায় চৌধুরীর মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে নকশা আঁকার কাজে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, সমরজিৎ রায় চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, সংবিধান থাকবে, সরমজিৎ রায় চৌধুরীর নামটি তত দিন থাকবে। তিনি যদি আর কোনো কাজ না-ও করতেন, এই একটি কারণে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আমরা কেবল একজন বড় মাপের শিল্পী বা শিক্ষককে হারাইনি, একজন বড় মাপের মানুষকে হারিয়েছি। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করতেন, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ করতেন।’ 

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, তাঁর মতো নিভৃতচারী শিল্পী দেশে খুব কম আছেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ভীষণ বিনয়ী। মনোযোগ দিয়ে কেবল নিজের কাজটি করে গেছেন, যেমন করেছেন শিল্পী কিবরিয়া, সফিউদ্দীন আহমেদরা।

শিল্পী হাশেম খান বলেন, সমরজিৎ রায় চৌধুরীর নামের সঙ্গে এক আভিজাত্য জড়িয়ে রয়েছে। এ আভিজাত্য তাঁর অহংবোধের নয়, এ ছিল তাঁর নিষ্ঠা ও ছাত্রদের প্রতি মমত্ব ও দায়িত্ববোধের। এভাবেই তিনি যুগে যুগে তাঁর নিকটজনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর শিল্পীসত্তা প্রসঙ্গে হাশেম খান বলেন, ‘তিনি কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি রং ও রেখায় বাস্তববাদী বা কল্পনার যে দৃশ্যকল্প এঁকেছেন, তাতে তিনি নিজস্ব এক শিল্পভাষা তৈরি করেছেন। তাঁর মতো শিল্পী-শিক্ষক কতশত বছর পর আসবে, আমরা জানি না। তাঁর শিল্পকর্ম আমরা যথার্থভাবে সংরক্ষণ করব।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত শিল্পীর ছেলে সুরজিৎ রায় চৌধুরী বলেন, ‘বাবা আমার বন্ধু ছিলেন। এমন কোনো বিষয় ছিল না, আমি বাবার সঙ্গে আলোচনা করতাম না, তর্ক-বিতর্ক করতাম না। জীবনে চলার পথে যত সমস্যা হতো, সব সমস্যার সমাধান খুঁজতাম বাবার কাছে। জানি না তিনি আমার প্রতি কতটা সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি সব সময় আমাকে আশীর্বাদ করেছেন। বাবাকে হারিয়ে যে শূন্যতা, সেটা আমার কোনো দিন পূরণ হওয়ার নয়। আপনাদের মাধ্যমে বাবা ইহজগতে তাঁর যথাযথ মর্যাদা পেয়েছেন। আপনারা প্রার্থনা করবেন, তিনি যেন পরলোকেও তাঁর যথাযথ জায়গাটি পান।’

অগ্রজের প্রয়াণে শিল্পী রফিকুন নবী শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘সমরজিৎ রায় চৌধুরী দেশের শ্রেষ্ঠতম এবং জ্যেষ্ঠতম শিল্পীদের একজন। ১৯৫৯ সাল থেকে আমি তাঁকে চিনি। তিনি যখন চারুকলার শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী, তখন আমি চারুকলায় ভর্তি হই। তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন, শিক্ষকদের খুব আদরণীয় ছিলেন। 

আবেদিন (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন) স্যারসহ সবাই তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। এযাবৎ যত মানুষের সঙ্গে আমি ওঠাবসা করেছি, এত ভালো আর সৎ মানুষ আমি পাইনি। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন সিরিয়াস। তাঁর অনেক ছাত্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজ করছে। গ্রাফিকসে কাজ করলেও অঙ্কনে তিনি নাম করেছিলেন। ফোক ও গ্রাফিকসের মিশেলে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব একটি ধরন।’

চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থেকে দেশ স্বাধীনে আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী। স্বাধীনতা-উত্তর বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে নানা দিক থেকে শোভিত করার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন তিনি। সরকারি দাপ্তরিক ডিজাইন সম্পৃক্ত বহু কাজ করেছেন। বহু লোগো, সার্টিফিকেট, মেডেল, পদক, পোস্টারের নকশায় যে অল্প কজন শিক্ষক যুক্ত ছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের চেয়ারম্যান শিল্পী রশিদ আমিন বলেন, ‘ছাত্র হিসেবে দীর্ঘদিন তাঁকে দেখেছি। আদর্শিক শিক্ষকতার যুগ ছিল তখন। তিনি ছিলেন সেই যুগের আইকন। পাংচুয়ালিটি, অ্যাকাউন্টিবিলিটি, দায়িত্ববোধের কারণে আমি তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে একসময় যে একটা গর্বের জায়গা ছিল আমাদের, সেটা তৈরিতে তাঁর মতো মানুষের বড় ভূমিকা ছিল। শিক্ষকতার আদর্শের একটি স্তম্ভ যেন আজ ধসে গেল।’  

শেষশ্রদ্ধার পুষ্পস্তবক : চারুকলা অনুষদ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সমরজিৎ রায় চৌধুরীকে শেষশ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ, ঢাকা আর্ট কলেজ, চারুকলা অনুষদ, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ চারুশিল্প সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, শিল্পকলা একাডেমি, খেয়ালী নাট্যগোষ্ঠী, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, অসীম কুমার উকিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিবিষয়ক উপকমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, চারুকলা অনুষদ ছাত্রলীগ, শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় জাদুঘরসহ বেশ কিছু সংগঠন।

শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান আজিজুল হক, শিল্পী শেখ আফজাল, বিপদভঞ্জন কর্মকার, শাহনুর মামুন, ওয়াকিলুর রহমান, আবুল বারক আলভী, কনকচাঁপা চাকমা, শহিদ কবির, ফরিদা জামান, মুনিরুজ্জামান, রোকেয়া সুলতানা, গৌতম চক্রবর্তী, সংগ্রাহক ময়নুল আবেদিন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা প্রমুখ।

রোববার (৯ অক্টোবর) বেলা ২টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী। সন্ধ্যায় শেষবারের মতো তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় কাঁটাবনের বাড়িতে। রাতে তাঁর মরদেহ রাখা হয় বারডেমের হিমঘরে। সকালে চারুকলা ও শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সবুজবাগ শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

শারীরিক অসুস্থতার কারণে ৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে সময় তাঁর শরীরে এআইসিডি (পেসমেকারের উন্নত সংস্করণ) স্থাপন করা হয়। দুই সপ্তাহ পর বাড়িতে নেওয়া হলে তিন দিন পর তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁর নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। অসুস্থ অবস্থাতেও সব সময় পরিবারের খোঁজখবর নিতেন সমরজিৎ রায় চৌধুরী। বাড়িতে ফেরার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিলেন তিনি। তাঁর ছেলে সুরজিৎ জানান, দীর্ঘ ৭০ বছর তাঁর বাবা চারুকলার সঙ্গে যুক্ত। এ সময় সাফ গেমসের ডিসপ্লে, দ্বিতীয় সাফ গেমস ‘দুরন্ত-২’-এর লোগো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো, সুপ্রিম কোর্ট, বিমানবাহিনীর লোগোসহ বহু লোগো অঙ্কনে যুক্ত ছিলেন তিনি। ৪৩ বছর চারুকলায় শিক্ষকতা শেষে অবসর নিয়ে ডিন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির চারুকলা এবং প্রদর্শন কলা বিভাগে। সেখানে ২০১০ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। পরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার নিউমেরারি প্রফেসর হন তিনি।

সমরজিৎ রায়ে চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৭ সালে। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) গ্রাফিক ডিজাইনে স্নাতক সম্পন্ন করেন। সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। টানা ৪৩ বছর দায়িত্ব পালনের পর অধ্যাপক হিসেবে ২০০৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

কমার্শিয়াল আর্ট বা গ্রাফিক ডিজাইনে স্নাতক অর্জন করলেও দ্রুত তিনি সৃজনশীল চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। প্রথম দিকে নিসর্গ, গ্রামীণ জীবন ও নাগরিক জীবন তাঁর তেলরঙের বিষয় হয়। পরে বিষয় নির্বাচন, রঙের ব্যবহার এবং উপস্থাপনার আঙ্গিকে অনন্য দক্ষতা তৈরি করেন। চিত্রকলায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। তিনি শিল্পকলা পদকও পেয়েছিলেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই