সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাগুলো বড্ড তিক্ত!

  • সাজেদা হক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০১৮, ০৬:২৭ পিএম

ঢাকা : আমি সাংবাদিকতা শুরু করেছি ২০০৫ সালে। সালমা সোবহান ফেলোশীপ দিয়ে। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন জাহিদ রেজা নূর, শাহেদ মোহাম্মদ আলী, রোবায়েত ফেরদৌস, মীর মাসরুর জামানসহ পরিচিত বহু গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব। তাঁরা সবাই যথেষ্ট আন্তরিক এবং দক্ষ প্রশিক্ষক ছিলেন।

টানা এক বছর হাতে-কলমে সংবাদ ও সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন আমাদের। এক বছর ধরেই প্রথম আলোতে আমরা ৩২ জেলার ৩২ জন নারী লিখতাম। শিক্ষকরা শুধরে দিতেন। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম প্রথমবারের মতো দেখলাম প্রথম আলোতে! শিরোনাম, ‘ধান থেকে চাল, মাঝে চাতাল কন্যা’, তারিখ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৫। সেই শুরু, এরপর আর থামতে হয়নি...।

এক বছর মাসে অন্তত চারটা লেখা ছাপা হতো প্রথম আলোতে। এরপর যোগ দিয়েছিলাম দেশবাংলা পত্রিকায়। সেখানেই মূলত বিভিন্ন বিভাগে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম আবু তাহের, কাজী রফিক, শামসুল হক ভাইসাবসহ অনেককে। সেসময় এই আমিই সম্পাদনা করতাম মহানগরের থানাভিত্তিক কন্ট্রিবিউটরদের লেখা নিয়ে মহানগর পাতা, যাদের অনেকেই এখন স্বনামখ্যাত। সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলাম সিঁড়ি, আমাদের বিদ্যালয় পাতারও। এ ছাড়া নিয়মিত পাজল সুডুকু এবং সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী স্যারের অনুবাদ খুশবন্ত সিং-এর সম্পাদনা করেছি দীর্ঘদিন।  

২০০৭ সালের শেষের দিকে যোগ দেই একুশে টেলিভিশনের ন্যাশনাল ডেস্কে। সরাসরি সিনিয়র হিসেবে পেলাম পলাশ আহসান ভাইকে। সেন্ট্রাল ডেস্কে ছিলেন মজুমদার জুয়েল, শহীদুল ইসলাম রিপন, রাশেদ চৌধুরী ভাইসহ আরও অনেকে। ২০০৯ সালের শেষের দিকে একুশে টেলিভিশন ছেড়ে যোগ দিয়েছিলাম যমুনা টেলিভিশনে। শুধু আমি না, আমরা অনেকেই যোগ দিয়েছিলাম যমুনা টিভিতে। অন এয়ারে আসার অপেক্ষায় যমুনাতেই কাটিয়েছি টানা এক বছর। পরে ২০১০ সালে ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেই বৈশাখী টেলিভিশনে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বৈশাখী ছাড়তে বাধ্য হই। সে আরেক ইতিহাস, এ ইতিহাস অন্যদিন। এরপর যোগ দেই নতুনমাত্রা.কম, রেডিও ধ্বনি এবং দৈনিক নতুন কাগজে। এখন কাজ করছি একটি সাপ্তাহিক ও অনলাইনে।

শুরু করে এখন ২০১৮। এক যুগেরও বেশি সময়, অনেক সহকর্মী এবং বহু অভিজ্ঞতা। তিক্ত অভিজ্ঞতাই বেশি। কারণ জানি না। খুব কম স্মৃতি আছে আনন্দের। তবে ভালো মানুষের সাহচার্য নেহায়েতও কম নয়।

দেখেছি কিভাবে অল্প সময়ে গাড়ি-বাড়ির মালিক বনে গেছেন বহু সহকর্মী। কান পড়ানি দিয়ে বহুজন পদোন্নতি পেয়েছেন। অকারণে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন অনেকেই। অনেকের আঙ্গুলের ইশারাতেই চাকরি হারিয়েছে বহু সংবাদকর্মী। আবার চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বহিষ্কারের কারণও অনেকের অজানা। এই যে ‘আঙ্গুলের ইশারা’-এ কেবল বড় পদে থাকা পুরুষ সহকর্মীরই নয়, নারী সহকর্মীও দিয়েছেন।

দিনের পর দিন কাজ করার অভিজ্ঞতায় এইসব বড় ভাই-বোনদের সম্পর্কে ধারণা আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে। কখনো কখনো প্রতিবাদ করেছি, কখনো কখনো করিনি, করতে পারিনি, সয়েছি-গণমাধ্যমের ভাষায় ‘এডজাসস্ট’ করেছি। প্রয়োজনীয় সাহসের অভাব, অজ্ঞতা এবং প্রয়োজন (বেঁচে থাকার দায়) বাধ্য করেছে। এই বাধ্যটাকে অনেকে আমাদের নিজের সঙ্গে নিজের নৈতিকভাবে পরাজয়ও বলতে পারেন।

সাংবাদিকদের অনেকগুলো সংগঠন। অনেক সুযোগ, অনেক সুবিধা তাতে। সেসব সংগঠনকে এতোদিন সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠন মনে করে দূরেই ছিলাম। ভাবছিলাম বড় ভাই-বোনদের হাতে নিরাপদ আমাদের অধিকার। অথচ এ ধারণা ভুল। কারণ আমি দেখেছি এই ১২ বছরেরও বেশি সময় পর আমার মতো অনেকেই নিঃস্ব। অথচ আমার পরে সাংবাদিকতা শুরু করে এখন অনেকে ফ্লাট, প্লট, গাড়ির মালিক। লাক্সারিয়াস তাদের জীবন যাপন।

এই দিক থেকে তারা অনেক ভাগ্যবান। সময়ের সঙ্গে গাঁ ভাসিয়ে অনেকে আজ অনেক দূরে..। তাদের জন্য শুভ কামনাও। কিন্তু আমি পারিনি। এই যে, নৈতিক স্খলন! এটা আমাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খেয়ে ফেলবে ভয় থেকেই আমি আমার মাঝে বন্দি হয়ে পড়ি। বিশ্বাস ছিল, একদিন আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সিনিয়রগণ, যাঁদের আমি বা আমরা অনেকেই আলোকিত ভাবি। যাঁরা আমাদের নৈতিক অধিকার ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার না করে সাংবাদিক স্বার্থকে মনে করবে। সংবাদকর্মীদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে।

দুঃখ জনক হলেও সত্য, এখানেও আমরা অসহায়! সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের নামে এই যে বিভিন্ন সংগঠন, এসব সংগঠনে নেতৃত্বে কারা?-এর উত্তর অনেকের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতাও মিলে যাওয়ার কথা। কারণ সংগঠনের আড়ালে সুবিধা নেয়া সকল নেতারাই আমাদের সামনে। চোখের সামনে অন্যায়গুলো করেছেন, করছে। কিছু সাংবাদিক স্বার্থহানীর কারণে প্রতিবাদ করেছেন বটে। তবে আমার মতো ঝামেলামুক্ত থাকার ইচ্ছাপোষন করা সাংবাদিকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নন, তাই তারা দূরেই ছিলেন এবং এখনো দূরেই আছেন।

বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেন অর্থাৎ যারা এই পেশাটাকে আদর্শ মনে করে সে মতে চর্চা করেন তারা সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বা আন্দোলনে আসেন না বললেই চলে। ভোটও দেন না। মাঝে মাঝে অংশ নেন। এর কারণ একটাই, অধিকার আদায়ের নামে স্বার্থ-অর্থ-সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কামড়া-কামড়িতে তারা নেই। আর এই যে না থাকা, এই না থাকার কারণেই মাঠ কিন্তু ফাঁকা। আর এই ফাঁকা মাঠেই গোল দিয়ে দিয়ে আজ অনেকেই নেতা।

আজ অনেকদিন পরে হলেও অনুধাবন করছি, এই দূরে থাকাটাই তাদের এগিয়ে দিয়েছে। তাদের একক নেতৃত্ব, জবাবদিহিতার অভাবে তারাও আজ ঔদ্বত্য দেখাতে দ্বিধাগ্রস্তবোধ করে না। এটা ব্যক্তি সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির জন্য সত্যিই লজ্জার, হতাশা। জাতির কাছে সাংবাদিকের মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করার অপকৌশল।

এটা আমার উপলব্ধি। সেই উপলব্ধি থেকেই এক বছর আগে থেকেই বলেছিলাম নির্বাচনে অংশ নেবো। আমি মনে করি আমরা যারা সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, যারা দেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন বাজী রাখতে প্রস্তুত, যারা অন্যায়কে রুখে দেয়ার সাহস রাখি; তাদের উপরই এসব সংগঠন থেকে জঞ্জাল সরানোর দায়িত্ব বর্তায়। আর এ দায়িত্ব কেউ কাউকে দেবেন না। বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক করা মহল।

সেই সিদ্ধান্ত থেকেই এবারের ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) নির্বাচন ২০১৮-এ অংশ নেয়া। তবে কার সঙ্গে থাকবো-এটি একটি কঠিন প্রশ্ন ছিল বটে। এ নিয়ে খুব বেশি একটা জটিলতায় পড়তে হয়নি। জাফর ওয়াজেদ ভাইয়ের মতো ঋদ্ধ মানুষের সাহচর্যে থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ, কে হাতছাড়া করে বলেন? তাই সাত-পাঁচ চিন্তা ছাড়াই আহবানে সাড়া দিতে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি।  

নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা! রীতিমত দুর্বৃত্তদের সাহস এখন এতো বেড়ে গেছে যে প্রহসণের নির্বাচনেরও আয়োজন করেন তারা! এক কথায় মাগুরার নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে এবার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) নির্বাচন। আর কারা মাগুরা মার্কা নির্বাচনের সকল আয়োজন করেছে তারা আমাদের সকলের পরিচিত, শ্রদ্ধেয়। অথচ সেই সাংবাদিকতার শুরু থেকেই এই বড় ভাইদেরকেই আদর্শ মনে করেছি এবং অনেকেকে এখনো করি। তাদের কাছেই সংবাদকর্মীদের নিরাপদ বোধ করেছি। অথচ সময়ের ব্যবধানে এই তারাই পরিণত হয়েছেন লোভী মানুষে। কেউ অর্থের লোভে, কেউ পদের লোভে, কেউ সুবিধা ভোগের লোভে শুধু নিজেকেই বিতর্কিত করেনি; জাতির বিবেকখ্যাত সাংবাদিক নির্বাচনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে!

এখানে সহজভাবে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, আমরা সাংবাদিক মহল কীভাবে দেশের স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের ভুল, কারচুপি, জালভোট, পেশিশক্তির অপব্যবহার, টাকার ছড়াছড়ি আর রাজনৈতিক মহলের কাদা ছোড়াছুড়ির কথা দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরব? যেখানে সর্বকালের বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) নির্বাচন-২০১৮!

আমার এই লেখা সেইসব সিনিয়রদের জন্য নয়, যারা এখনো আদর্শচ্যুত হননি বা যাদের কথায়-বলায় এবং চলায় এখনো স্নেহ ঝড়ে। যাদের আশীর্বাদে অন্তর তৃপ্ত হয়। আমার লেখাটা সেই সব সিনিয়রদের বিপক্ষে যারা আদর্শের লেবাস ধরে সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, করেছেন এবং আগামীতে সাংবাদিকতাকে একটি অনিশ্চিত পেশায় পরিণত করার নেশায় বুদ।

আরেকটি জিনিস অত্যন্ত ভয়ঙ্করভাবে উঠে এসেছে। কতিপয় সাংবাদিক নেতাও আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দৃশ্যমান ফেরি করলেও অদৃশ্যের আঁতাত স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসর মহলের স্বার্থে! এটা কি শেখ হাসিনার হাতকে ঘুণে খাওয়া কাঠের মত শক্ত করার অপকৌশল-সেটা না হয় সরকারের একান্ত ভাবনার বিষয়ের ওপর ছেড়ে দিলাম।

কিন্তু আমি আতঙ্কিত, ভীত। আমার আহ্বান থাকবে- আদর্শিক লড়াইয়ে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। আপনারা আসছেন না বলেই দখল হয়ে যাচ্ছে সাংবাদিকদের সবগুলো সংগঠন। পরিণত হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। এদের প্রতিহত করতে হবে। দয়া করে কেউ কষ্ট পাবেন না, আমার কষ্টটা একটু অনুধাবন করবেন। হয়তো আমার কথাই না বলা অনেক সংবাদকর্মীর কথা। একই সঙ্গে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর সমস্যাগুলোকে যারা জঞ্জাল মনে করে দূরে সরে আছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ- আসুন, জাতির বিবেকখ্যাত সাংবাদিকের মর্যাদা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হই। যারা শেখ হাসিনার হাতকে ঘুণে খাওয়া শক্তিশালী করার অপচেষ্টা করছে; এখনি তাদের প্রতিহত করি। নয়তো সাংবাদিকের কালিও একদিন আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বোয়াফ

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর