শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

মর্মন্তুদ স্মৃতিঘেরা একদিন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯, ০১:৫৩ পিএম

ঢাকা : বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিজয়ের আগে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এভাবে হত্যা করার দিনটি বাঙালির ইতিহাসে বেদনাবিধুর। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণার একদিন। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে বাঙালি কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের প্রতীক্ষায়, পূর্ব দিগন্তে টগবগিয়ে যখন বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, ঠিক তখনই চালায় ইতিহাসের নৃশংস ও নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। বছর ঘুরে আজ আবার এসেছে সেদিনটি।

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রতিবছর জাতি গভীর শ্রদ্ধায় এদিন স্মরণ করে সেসব শহীদদের। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও প্রণয়ন হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ৪৮ বছর কেটে গেলেও তাদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই।

সরকারি উদ্যোগে দুই বছরের বেশি সময় আগে, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকা বই আকারে প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা আজো আলোর মুখ দেখেনি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী কারা, বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্টকরণ হয়নি বলে ফলে সারা দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কত-তা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি এখন দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।

স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তখনকার সরকার। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারিভাবে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’।

এ কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেমে যায় ওই সরকারের কার্যক্রম। ফলে ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’ ও ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’র কার্যক্রমও আর এগোয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল পরাক্রমের সামনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার ও ঘাতক বাহিনী এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল।

বাঙালিকে মেধা ও মননশূন্য করতে তারা বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের অগ্রগণ্য সহস্রাধিক বরেণ্যজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই দিনটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর, ইতিহাসের পাতায় কালো আখরে উৎকীর্ণ বেদনাবিধুর কালবেলার দিন।

বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুদিন পর ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিজয়ের প্রাক্কালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এভাবে হত্যা করার দিনটি বাঙালির ইতিহাসে বেদনাবিধুর। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণার এক দিন। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে বাঙালি কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের প্রতীক্ষায়, পূর্ব দিগন্তে টগবগিয়ে যখন বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, ঠিক তখনই চালায় ইতিহাসের নৃশংস ও নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। বছর ঘুরে আজ আবার এসেছে সেই দিনটি। আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রতি বছর জাতি গভীর শ্রদ্ধায় এ দিনে স্মরণ করে সেসব শহীদদের।

সেদিন বধ্যভূমিতে বড় অসহায় দশায় নিঃশেষে প্রাণ দেন দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা, যা বিশ্বকেও হতবিহ্বল করে তুলেছিল। সর্বস্তরের মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় আজ স্মরণ করবে তাদের। জনতার ঢল নামবে আজ ঢাকার মিরপুর ও রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। অগণিত মানুষ দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি স্মরণ করে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে। সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার ফুলে ছেয়ে যাবে তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ।

দিবসটি উপলক্ষে জাতীয়ভাবে বিস্তারিত কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। দেশের সর্বত্র আজ জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। শোকের প্রতীক কালো পতাকাও উড়বে।

দিবসটি স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি আজ সকাল ৭টা ৫ মিনিটে আর প্রধানমন্ত্রী সকাল ৭টা ৬ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। শ্রদ্ধার জন্য প্রস্তুত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধও। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হানাদাররা সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে শুরু করে বাঙালি নিধনযজ্ঞ।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস হানাদাররা গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রাখে। ডিসেম্বরে এসে চরম বিপর্যয় আসন্ন ও পরাজয় অনিবার্য জেনে তারা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার গোপন নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে হত্যা করে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে এভাবেই অন্ধকার করার পাঁয়তারা করেছিল।

‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে নামে তখনো দেশ ও দেশের বাইরে একটি উদ্বেগের বিষয় ছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের এভাবে হত্যা করা হতে পারে। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগের একটি খণ্ডচিত্র আঁকা আছে কবি ও অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের গদ্য রচনায়।

পাকিস্তানিরা এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে তা তুলে দেয় জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর হাতে।

১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই হিটলিস্ট অনুযায়ী পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মে তিনটি ঘাতক গ্রুপ মেতে ওঠে। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে।

ঘাতকরা রাতের অন্ধকারে বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর সারা দেশে একযোগে সর্বাধিকসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। অনেকের লাশই পাওয়া যায়নি। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিকামী জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। এ কারণেই তাদের প্রাণ কেড়ে নেয় দালাল ও ঘাতকরা।

দীর্ঘ চার দশক পর সেই ঘাতকদের বিচার হয়েছে। ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।

ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বদর নেতা ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্যদের। বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় বিচার এখনো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি ।

চৌধুরী মইনুদ্দীন যুক্তরাজ্য ও আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছে। তাদের ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আরো কয়েকজনের বিচার এখনো শেষ হয়নি।

আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখনো বিচার চলছে অন্য ঘাতকদের। তাই এবারের বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশের সবস্তরের মানুষ নতুন করে শপথ নেবেন—সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাকিদেরও বিচারের রায় কার্যকরের।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল ঢাকা ও এর আশপাশে ৪৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীসহ সবস্তরের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন—অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডা. মোহাম্মদ শফি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদল্লা কায়সার, নিজামউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার আবু তালেব, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, সৈয়দ নাজমুল হক, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, ড. আবদুল খায়ের, ড. সিরাজুল হক খান, ড. ফয়জল মহী, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক হবিবুর রহমান, কবি মেহেরুন্নসা ও গিয়াস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দল নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মৃতিচারণ ও চিত্রপ্রদর্শনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করছে। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বেতার, বিটিভি, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও এফএম রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠান সমপ্রচার করবে।

জাতীয় দৈনিকগুলোতেও বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভার আয়োজন হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই