ভয়াবহ বন্যা

৫ জেলায় মানবিক বিপর্যয় 

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২৩, ০৯:১৪ এএম

ঢাকা: সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে কয়েকদিন ধরেই দেশের বেশিরভাগ স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে দুর্দশায় পড়েছেন পার্বত্য অঞ্চলসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।

মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এসব জেলার বেশিরভাগ স্থানে পানিবন্দি অবস্থায় লাখো মানুষকে দিন কাটাতে হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে মানুষ ভেসে যাওয়া ও পাহাড় ধসে মাটিচাপার মতো ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি।

সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে খাগড়াছড়ির সঙ্গে লংগদুর। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর এলাকা ও সাতকানিয়ার কেরানিহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের ওপর দিয়ে কোমর সমান পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল থেকে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। 

কার্যত মঙ্গলবার সকাল থেকেই চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। 

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় বুধবার ও বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

এদিকে লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও দুমকিতে তলিয়ে গেছে আমন-সবজি খেত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে তিন শতাধিক চাতাল কলে চাল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বরিশালের বাবুগঞ্জের রহমতপুর-মীরগঞ্জ সড়ক ও বিমানবন্দর বিলীন হওয়ার পথে। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ভেঙে গেছে কয়েকটি সড়ক। বাগেরহাটে ৭৫১০ মানুষ পানিবন্দি ও তলিয়ে গেছে ঘের। 

ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া ও ফেনীর মহুরি ও কহুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বগুড়ায় ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ২১৩ মিলিলিটার। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় সড়ক-মহাসড়ক থেকে অনেক এলাকার ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট, পুকুর, ফসলের মাঠ। নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। 

[204624]

চট্টগ্রাম, বাঁশখালী, রাউজান, হাটহাজারী ও রাঙ্গুনিয়া : 
জেলার ১৫টি উপজেলার মধ্যে সন্দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪টিই বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৮টি উপজেলা মারাত্মকভাবে বন্যাকবলিত হয়েছে। নগরীর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও উপজেলাগুলোর অবস্থা সোমবার রাত থেকে নাজুক হতে শুরু করে। বাড়তে থাকে পানি। মঙ্গলবার সকাল নাগাদ বন্যার পানিতে প্লাবিত হয় সড়ক-মহাসড়ক থেকে অনেক এলাকার ঘরবাড়ি-রাস্তাঘাট, পুকুর, ফসলের মাঠ।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর এলাকা ও সাতকানিয়ার কেরানিহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সকাল থেকে আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। কার্যত মঙ্গলবার সকাল থেকেই চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে উদ্ধারে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী এই দুই উপজেলায় ১২০ জন করে ২৪০ জন সেনাসদস্য কাজ শুরু করেছেন। 

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার ৬ লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, সেনাবাহিনী লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলায় পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধার করা শুরু করেছে। সাতকানিয়ার ১৭টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। লোহাগাড়ার ৬টি ইউনিয়নে পানি উঠেছে। সেখানে যারা পানিবন্দি অবস্থায় আছেন তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। আমার জানামতে, দুই উপজেলার প্রত্যেকটিতে ১২০ জন করে সেনাসদস্য কাজ করছেন। লোহাগাড়া উপজেলার আমীরাবাদ ইউনিয়নে বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন জুনায়েদুল ইসলাম জারিফ নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। 

রোববার রাতে ঢলের স্রোতে ভেসে যাওয়ার পর সোমবার সকালে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। জারিফ লোহাগাড়া উপজেলার আমীরবাদ ইউনিয়নের ভুট্টোর ছেলে। তিনি চন্দনাইশের বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন।

খাগড়াছড়ি: 
মঙ্গলবার সকালে পৌর শহরের কলাবাগান, শালবন ও সবুজবাগ এলাকায় পাহাড় ধসে প্রায় ২৫টি বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া দীঘিনালাসহ আরও ৭ উপজেলায় অন্তত আরও ২৫-এর বেশি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে দিনের বেলায় হওয়ায় জানমালের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সকালে ভারি বর্ষণের কারণে আকস্মিকভাবে পাহাড়ের ধসের এ ঘটনা ঘটেছে। অব্যাহত বর্ষণের কারণে খাগড়াছড়িতে ধসে গেছে সড়কের মাটি।

রাঙামাটি: 
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, টানা বর্ষণে জেলায় এ পর্যন্ত ১৯৮ স্থানে পাহাড়ধস ও ভাঙন হয়েছে। এতে ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতি হয়েছে ১৪টি। বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়েছে ১৬টি। বাড়িঘর ক্ষতি হয়েছে ৩৮১টি-যার মধ্যে আশ্রয়ণের ঘর রয়েছে ১০টি। আহত হয়েছেন ১০ জন। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬৮৩ একর। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কসহ জেলায় ৭৫টি স্থানে পাহাড় ধসে সড়কের ক্ষতি হয়েছে। 

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৯টি স্থানে সাময়িকভাবে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। তীব্র স্রোতে রাঙামাটি-বান্দরবান সড়কের চন্দ্রঘোনা ফেরি চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ চালু হবে তা নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা। এছাড়া পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের জন্য জেলায় মোট আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ২৩৪টি। এসব কেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন ঝুঁকিতে থাকা ও দুর্গত লোকজন।

[204617]

কক্সবাজার ও চকরিয়া: 
গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সব নদী-খালের পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত জেলার ৭টি উপজেলার কমপক্ষে ৬০টি ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ভেঙে গেছে কয়েকটি কালভার্ট। জেলায় প্রায় দেড়শ কিলোমিটার কাঁচা ও পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, সদর ও ঈদগাঁও উপজেলার বাসিন্দারা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের প্লাবিত ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৩১টি, যা মঙ্গলবার এসে দাঁড়িয়েছে ৬০টি ইউনিয়নে। জেলায় সবচেয়ে বেশি প্লাবিত এলাকা চকরিয়া ও পেকুয়া, কুতুবদিয়ায় এবং ঈদগাঁওতে।

বান্দরবান: 
পানিতে ভেসে নাইক্ষ্যংছড়িতে ম্রো সম্প্রদায়ের ১ জন ও টংকাবর্তীতে ১ জন নিখোঁজ রয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ছাত্রাবাস থেকে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিদ্যুতের সাবস্টেশনগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে ৩ দিন। আজ মঙ্গলবারও অবিরাম বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে জেলার সাতটি উপজেলায়। বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। পাহাড় ধসে কালাঘাটা গুদারপাড় এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

নিহতরা হলেন-নূর নাহার (৪২) ও সাবুকননেছা (১৪)। অপরদিকে নাইক্ষ্যংছড়িতে পানিতে ভেসে ম্রো সম্প্রদায়ের ১ জন নিখোঁজ রয়েছে।

রায়পুর (লক্ষ্মীপুর):
রায়পুরের উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী, উত্তর চরআবাবিল ও দক্ষিণ চরআবাবিল ইউনিয়নের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। মেঘনা উপকূলে বেঁড়িবাধ থাকালেও জোয়ারের নদী তীরবর্তী ইউপিগুলোর বাসিন্দাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।

আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া): 
আশুগঞ্জে তিন শতাধিক চাতালকলে চাল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার চাতাল শ্রমিক কোনো কাজ করতে না পারায় মজুরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

রাঙ্গাবালী ও দুমকি (পটুয়াখালী): 
রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের তিল্লা, নয়াভাঙ্গুনি, সাজির হাওলা, কোড়ালিয়া ও চরইমরাশন ঘুরে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টিতে তলিয়েছে আমন ও আউশের বিস্তীর্ণ মাঠ।

বাবুগঞ্জ (বরিশাল): 
জোয়ারের পানি কমতে থাকায় ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম দিন কাটাচ্ছে নদীপারের মানুষ। উপজেলার ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামের শতাধিক পরিবার সুগন্ধার ভাঙন আতঙ্কে রাত পার করছে। উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ রহমতপুর-মীরগঞ্জ সড়কসহ ক্ষুদ্রকাঠি গ্রাম ও বাবুগঞ্জ বাজার সুগন্ধা নদীর ভাঙনের আশঙ্কায়।

[204610]

ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর): 
ফরিদগঞ্জ উপজেলার নিুাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বীজতলায় পানি জমেছে। কয়েকটি সড়কের পাশে থাকা গাছ উপড়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়ক।

বাগেরহাট: 
বাগেরহাট শহরের বেশির ভাগ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় ১৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে মোংলা আবহওয়া অফিস। জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৭৫১০টি পরিবার। তলিয়ে গেছে ১৫৮০টি মাছের ঘের।

বগুড়া: 
বগুড়ায় মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় ২১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আবহাওয়া অফিস বলছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ও নিুচাপের কারণে বৃষ্টি হচ্ছে। যা আরও ২-৩ দিন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ কম হবে।

ঝালকাঠি: 
কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের ঢালির খালের বাঁধ ভেঙে নতুন করে ১১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত পাঁচ দিন ধরে টানা বৃষ্টি আর জেয়ারের পানিতে জেলার অন্তত ২০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে পানির স্রোতে আর ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যাচ্ছে কাঁচা রাস্তাঘাট।

ফেনী: 
মুহুরী নদীর ফুলগাজী ও পরশুরামের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে প্লাবিত হয়েছে কমপক্ষে ২০টি গ্রাম।

এআর