গণঅভ্যুত্থানে ১৩২ শিশু শহীদ, রক্ত আর স্বপ্নের গল্প

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৫, ০৪:২৫ পিএম
ফাইল ছবি

ঢাকা: গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা থেকে জেলা শহর, মহল্লা থেকে বাড়ির ছাদ পর্যন্ত। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের প্রতিরোধে।

এই আন্দোলনে যেমন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পেশাজীবী, শ্রমজীবী মানুষ, তেমনি ছিল শিশুরাও। কেউ পরিবার নিয়ে অংশ নিয়েছিল, কেউ নিজের স্কুলব্যাগ নামিয়ে বাসা থেকে রাস্তায় নেমেছিল। কেউ পাশের ছাদে, কেউ শুধু জানালায় দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাদের শরীরেও বিদ্ধ হয় ঘাতকের গুলি। 

সবকনিষ্ঠ শহীদ আব্দুল আহাদ। চার বছর বয়সি এই শিশু গত বছরের ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আহাদ সকালবেলা বাসার অষ্টম তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল তার বাবা-মায়ের মাঝে। হঠাৎ একটি গুলি এসে ডান চোখে বিদ্ধ করলে সে মেঝেতে পড়ে যায়। বাবা-মা হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাদের কোলের সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

আরেক শিশু, ছয় বছর বয়সি জাবির ইব্রাহিম, উত্তরা দক্ষিণখানের বাসিন্দা, সে দিন নার্সারিতে পড়ত। তার পরিবার সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল আন্দোলনে। ৫ জুলাই বিকেল ৪টার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচমকা ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলিতে জাবিরের পায়ে আঘাত লাগে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পথেই শহীদ হয় শিশুটি। বাবা কবির হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলেকে উৎসর্গ করেছি দেশের জন্য। যদি এই রক্তে মানুষের মুক্তি আসে, তবে আত্মত্যাগ সার্থক।’

ছয় বছর সাড়ে ছয় মাস বয়সি রিয়া গোপের মৃত্যু ঘটেছে নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটিতে। সে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। বাবার কোলে নেওয়ার মুহূর্তে মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যু হয়। রিয়ার বাবা-মা দীর্ঘক্ষণ নিঃশব্দে কাতর হন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগেও একই দিনে অভ্যুত্থানে শিশু আহাদের মৃত্যু ঘটে। সাত বছর বয়সি সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, নিচে সংঘর্ষ চলছিল। হঠাৎ গুলি মাথায় আঘাত হানে এবং আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা অবস্থায় রাতেই মৃত্যু হয়।

১৫ বছর বয়সি নাঈমা সুলতানা, ছবি আঁকতে ভালোবাসত। বাসায় বসে আঁকছিল, হঠাৎ বারান্দায় গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার মা আইনুন নাহার বলেন, ‘এক মুহূর্তেই আমার মেয়ে চলে গেল হাতের মধ্যেই।’

কিশোররাও শহীদ হয়েছেন। ১৭ বছর বয়সি শফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ ৪ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ১৬ বছর বয়সি আবদুল্লাহ আল মাহিন, উত্তরা আজমপুরে ছররা গুলিতে মারা যান।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই গণঅভ্যুত্থানে ১৩২ শিশু ও কিশোর এবং ১১ নারী শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার, যাদের মধ্যে ৫০০ জন চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।

শিশু শহীদরা রাজনীতি বোঝার বয়সে ছিল না। তারা শুধু মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। তাদের রক্ত আমাদের মানবিকতা, নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রীয় বিবেকের প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তাদের মৃত্যু সংখ্যা নয়, এগুলো একেকটি পরিবারের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। আজ তারা জীবিত নেই, কিন্তু বাংলার বাতাস, মানুষের প্রতিবাদের স্লোগান এবং ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে ‘শিশু শহীদ’ হিসেবে।

এসএইচ