পঁচাত্তরের পনেরোর পুনরাবৃত্তি

  • বিশ্বজিত রায় | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০১৯, ০১:০১ পিএম

ঢাকা : ২১ আগস্ট ইতিহাসের আরেকটি কালো দিন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত জনসভায় ঘটেছিল ইতিহাসের ভয়ঙ্কর নারকীয় গ্রেনেড হামলা, যে হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন। যার মধ্যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী নারীনেত্রী আইভি রহমানও রয়েছেন। এতে আহত হয়ে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা ভোগ করছেন কয়েকশ নেতাকর্মী। আর সৌভাগ্যের সারথি হিসেবে বেঁচে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কর্ণধার ও বর্তমান বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপকার শেখ হাসিনা। এই হামলা যেন পঁচাত্তরের পনেরোর পুনরাবৃত্তি।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পুনরাবৃত্তি চালিয়ে জাতিকে আবারো নেতৃত্বশূন্য করার ছক কষেছিল ঘাতকরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে হন্তারকরা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকে অভিভাবকশূন্য করার যে অদ্ভুত অপচেষ্টা চালিয়েছিল, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তারই ধারাবাহিকতা। ১৯৭৫-এ বিদেশে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে ফের বেঁচে যান ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড বিস্ফোরিত বধ্যভূমি থেকে। সেই ভয়াল বীভৎস গ্রেনেড হামলাটি ছিল ১৫ আগস্ট থেকে একটু ব্যতিক্রম। পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর্বটি খুনি জল্লাদরা শেষরাতের নির্জন নিভৃত পরিবেশে সংঘটিত করলেও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বোমা বারুদে উড়িয়ে দেওয়ার সময়টা ছিল হাজারও মানুষের সমাগমে স্বয়ংসম্পূর্ণ দিবালোকে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাটি ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে তখনকার বিরোধীদলীয় প্রধান শেখ হাসিনা খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শেষে যখন সমাবেশস্থল ত্যাগ করতে যাচ্ছিলেন, তখনই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেড। দ্রুত একের পর এক বিস্ফোরিত হওয়া গ্রেনেড যুদ্ধক্ষেত্রকেও হার মানিয়েছে। গ্রেনেডের বিদঘুটে শব্দ আর শক্তিশালী আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা নিস্তেজ দেহের ওপর দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষের ছোটাছুটির ভীতিকর পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সৃষ্টি করেছে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। যাকে হত্যার জন্য নারকীয় এই আয়োজন করেছিল ঘাতকরা, সেই শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে।

সেদিন শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে ঢাকার প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ দলের একাধিক শীর্ষ নেতা মানবপ্রাচীর সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। তারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা। এই বীভৎস হামলার শিকার আওয়ামী লীগ তখন মামলা দিতে গেলে সে মামলা নেওয়া হয়নি। তার আগে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। ভয়ঙ্করতম এই গ্রেনেড হামলার সঠিক তদন্ত না করে উল্টো তা ভিন্নদিকে নেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। জজ মিয়া নামের এক নির্দোষ নিরপরাধ যুবককে ধরে নিয়ে এসে ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করা হয়। এভাবে মিথ্যাচার ও বানোয়াট ভিত্তিতেই চলতে থাকে সাজানো মামলাটি।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু করে। তাতেই একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অবসান হয় জজ মিয়া নাটকের। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নতুনভাবে তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

তাতে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরো অনেক ব্যক্তি জড়িত আছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তারই ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।  

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও এতে সম্পৃক্ত আসামিদের দণ্ড হয়েছে। এই নির্মম নিকৃষ্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত প্রকৃত দোষীদের পরিচয় জেনেছে দেশবাসী। কিন্তু সেই আষাঢ়ে গল্পের তারকা সন্ত্রাসীখ্যাত আলোচিত জজ মিয়ার খবর কি কেউ রাখছেন?

জজ মিয়ার নিরপরাধ জীবনের ওপর চালানো অত্যাচার প্রশমিত হলেও থেমে নেই তার জীবন-যন্ত্রণা। রাজধানী শহরে গাড়ি চালিয়ে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করা জজ মিয়া গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার পর পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন, ‘রায়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু যাকে সবাই এতদিন ধরে মূল হোতা বলেছে, তাকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। আর তাকে (জজ মিয়া) মারধর-নির্যাতন করে যারা এ মামলা ভিন্নখাতে নিতে চেয়েছিলেন, তাদেরও যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আদালত।’

কিছুটা রুদ্ধ সুরে জজ মিয়া বলেন, ‘একটা মাস আমারে আটকায়ে কী যে মারা মারছে সিআইডি, বলার মতো না। যতক্ষণ না আমি সব স্বীকার করতে রাজি হইছি, ততক্ষণ চলছে নির্যাতন। এখনো সেই ব্যথা যায়নি। ডান হাতের হাড় ফেটে গিয়েছিল। মেরুদণ্ডের ব্যথাটা এখনো যায়নি।’ মিথ্যে মামলায় নতজানু জজ মিয়া ৩৭ বছরে বিয়ে করেছেন।

সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মামলা তো শ্যাষ। তয় নির্যাতন আর পত্রিকায় নাম উঠা ছাড়া আমি কী পাইলাম? এখন যদি সরকার আমার দিকে দয়ার দৃষ্টি দেয়, আমার বিষয়টা মানবিকভাবে দেখে।’ [সূত্র : প্রথম আলো, ১১.১০.১৮] অদ্ভুত মিথ্যাচার ও জোরজবরদস্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত জজ মিয়ার প্রতি রাষ্ট্রীয় সুনজর আশা করছি।  

লেখক : সাংবাদিক