পেঁয়াজ সমাচার ও আমাদের জীবনযাত্রা

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০৫:২৬ পিএম

সুলতান মাহমুদ আরিফ: ব্যচেলর ম্যাসগুলোর কথা বলতে গেলে নিজেই আঁৎকে উঠতে হয় মনের অজান্তে। কাজের বুয়া যখন বাসায় আসে রান্না করার জন্য মালিকপক্ষ সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে ভিবিন্ন গোপন ছিদ্র প্রয়োগে। কোনক্রমে বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে দামী সম্পদ পেঁয়াজ নিয়ে বুয়ার চৌর্য্ বিদ্যার প্রদর্শন চলবে না। 

সেদিন তো আমার ম্যাসের এক বড় ভাই কঠিন ভাষা প্রয়োগে বুয়া তথা খালাকে বলেই দিয়েছেন খাবারে পেঁয়াজের পরিমাণ আরো কমাতে হবে। একটার বেশি পেঁয়াজ দেওয়া যাবেই না। এভাবেই চলছে বর্তমানে পেঁয়াজ ভোগান্তির এক নির্মম পরিহাস। ২০১৯ সাল আমাদের কাছে ভিবিন্ন কারণে স্মরণী হয়ে থাকবে। আর ভিবিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হল পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি।  ঢাকার শহরে এখন পেঁয়াজ খুঁজে পাওয়াটা খুবই দুষ্কর। আপনি তিতুমীর কলেজ চত্বর থেকে শুরু পুরো ঢাকার শহরে একবার ঘুরে আসতে পারেন পেঁয়াজহীন ঝালমুড়ী চলছে বেচা-কেনা। বড়লোকের ছেলে-মেয়েদের জন্য একটা পেঁয়াজের সামান্য কিছু অংশ দিয়ে বানানো হয় ঝালমুড়ী। 

ঝালমুড়ী বিক্রেতা আগেই জিজ্ঞাসা করে আপনি কি স্পেশাল খাবেন নাকি নর্মাল? স্পেশালে পেঁয়াজ আর নর্মালে পেঁয়াজ ছাড়া। সেরা অনলাইন ভার্সুয়াল জগত তথা ফেসবুকের কল্যানে আপনি এরকম আরো দুর্বিষহ চিত্র অবলোকন করতে পারবেন। পেঁয়াজের এই চরম বৃদ্ধিতে ঢাকার শহরের অনেক ম্যাস কিংবা পরিবারে অনির্দিষ্ঠ কালের জন্য পেঁয়াজ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষনা চমকে উঠার মত কিছু না। পেঁয়াজের এই চরম নির্মমতার পরিবেশ চলমান থাকলে কিছু দিন পর হয়তো পত্রিকার পাতায় উঠে আসবে পেঁয়াজ না থাকাই বরিশালে চরম দূর্ভোগ। রংপুরে গৃহ বধুর আত্বহত্যার চেষ্টা। রাজশাহীতে একই পরিবারের তিন সদস্য পেঁয়াজ ডাকাতিতে গ্রেফতার। চাঁদপুরে পেঁয়াজহীন ইলিশের তরকারী। এভাবেই ভিবিন্ন জেলার আহাজারী প্রকাশ পাবে এই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ভয়ংকর যুগে। 

মিষ্টির দোকানগুলোও ধীরে ধীরে মুহ্যমানের দিকে চলে যাচ্ছে। আগে বড় ভাই কিংবা আশপাশের কেউ বিয়ে কিংবা ভালো চাকরি পেলে মিষ্টি খাওয়ার জন্য অন্যরা আবদার করতো। ধীরে ধীরে মিষ্টির আবদার গায়েব হযে যাবে। এখন থেকে কেউ ভালো চাকরী কিংবা বিয়ে করলে মিষ্টির পরিবর্তে সবাই পেঁয়াজ খাওয়ার জন্য উৎফল্ল থাকবে। বাসের ভিতরে যদি কাউকে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম পেঁয়াজ নিয়ে যেতে দেখা যাবে; তাকে সবাই অনায়াসে সিট ছেড়ে দিবে। 

ঢাকা শহরের সিটি নির্বাচনের আগে পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখতাম ভিবিন্ন প্রার্থিদের সম্পদের হিসাবে ভরপুর। এখন আর সেভাবে হিসাব আসবেনা । এখন থেকে নমিনেশন দেওয়া হবে পেঁয়াজের সংখ্যার ভিত্তিতে। পড়া-লেখার মান অনেক আগেই কমে গিয়েছিলো। বর্তমান চাকরির বাজারে মামা-খালু আর টাকা ছাড়া চাকরী পাওয়া খুবই দুষ্কর। তারপরেও ব্যাচেলররা হতাশ ছিলো না। কারণ, চাকরীর বাজার মন্দ হলেও কতকলোক তাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য টাকা-পয়সাকে প্রাধান্য না দিয়ে পড়া-লেখাকে প্রধান্য দিতো। এখন আর এমনটি হবে না। এখন থেকে কেউ বিয়ে করতে গেলে মেয়ে পক্ষ আগেই জিজ্ঞাসা করবে “ছেলে কত কেজি পেঁয়াজের মালিক”?

শাহবাগকে বলা হয় ফুলের রাজধানী। প্রিয়সীকে খুশি করার জন্য প্রেমিক ফুল কেনার জন্য পাড়ি জমাতো শাহবাগে । এখন এমন চিত্র ধীরে ধীরে বিলিন হওয়ার পথে পেঁয়াজের এই দাম বৃদ্ধিতে। প্রিয়সি এখন আর ফুলে খুশি না! প্রিয়সী এখন পেঁয়াজ হাতে তার বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে চাই।

বহুদিন পর স্বামী বিদেশ থেকে দেশে গমনে প্রিয়জনদের কত-শত আবদার থাকে। এখন আর সেই আবদারগুলো চোখে পড়ে না। এখন দেখা যায় স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে ওগো তোমার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই আসার সময় আমার জন্য অন্তত এক কেজি পেঁয়াজ আনিও।

ভিবিন্ন লাইব্রেরীগুলোতে একসময় “মেয়েপটানোর ১০১ টি উপায়” বইটি চরম চলত। বিভিন্ন জায়গায় এই বইয়ের ছিল ব্যাপক চাহিদা। এখন আর এই বইয়ের চাহিদা চোখে পড়ে না। এখন পেঁয়াজ হাতে দেখলেই মেয়েরা উপছে পড়ে।

এভাবে যদি পেঁয়াজ দুর্ভোগ চলতে থাকে দেশের অবস্থার কি হবে জানি না। তবে বহু তরুণী আর তরুনের বুকে নেমে আসবে দুর্বিষহ আর্তনাদ। কারণ- পেঁয়াজের মূল্যের বিবেচনায় কেউ কারো ইচ্ছা পুরণ করতে পারবে না। আগে কেউ চাকরী কিংবা বিয়ে করলে ১০ গ্রাম জানান দিতো। এখন আর এরকম চিত্র দেখা যাবে না। পেঁয়াজ খাওয়ানোর ভয়ে কেউ তার সাফল্য এখন আর প্রচার করবে না। 

তবে, এমনটি থেকে উত্তরণের এখনি সময়। এখনি সময় পেঁয়াজের লাগাম টেনে ধরার। না হলে হাজারো পরিবার আর ভালোবাসার সম্পর্কগুলো নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যাবে এই পেঁয়াজ নামক ভয়ংকর উর্ধ্বগতির কাছে।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশের মাটির উপর এক ঝাঁক ক্যাসিনো আর অসুদপায় সম্বলিত কিছু লোক থাকলেও মাটির নিচে আছে হাজারো সম্পদ। বলা চলে আমাদের বাংলাদেশের পুরা এরয়িাটাই হলো সম্পদ। এই দেশের ভূমি ফসল উৎপাদনে অনেক এগিয়ে। আমাদের বাংলাদেশে সবকিছু আমাদের চাহিদা মোতাবেকই রয়েছে।

পেঁয়াজের কথা যদি বলেন,দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ রয়েছে : দেশে বছরে মোট পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে গত ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে দেশে উত্পাদন হয়েছে ২৩.৭৬ লাখ টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে (ঋণপত্র নিষ্পত্তি) ১০ লাখ ৯২ হাজার টন পেঁয়াজ। সবমিলিয়ে মজুতকৃত মোট পেঁয়াজের পরিমাণ ৩৪ লাখ টনেরও বেশি। যদি ৩ থেকে ৪ লাখ টন ঘাটতি ধরা হয় তারপরও মজুতকৃত মোট পেঁয়াজের এই পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। তাহলে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কেন এই প্রশ্ন আজ ভোক্তাদের?

এর উত্তর একটাই সঠিক তদারকী আর সিস্টেমের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ যদি তার নিজ সম্পদকে সঠিক এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত করতে পারে , তাহলে কোন কিছুর জন্যই আমাদেরকে কারো কাছে হাত পেতে থাকতে হবে না। বাংলাদেশে চলমান ব্যবস্থায় ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে আর গরিব রয়ে যাচ্ছে গরিব। এটা সিস্টেম আর মন মানসিকতার কাছে ডিপেন্ড করে। আমাদের দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ রয়েছে । স্বাভাবিকভাবে এই ১৭ কোটি মানুষের রয়েছে ৩৪ কোটি হাত। এই ৩৪ কোটি হাতকে কেবল মালিকের হাতে পরিণত না করে কৃষক তথা শ্রমিকের হাতে পরিণত করা উচিত । 

আমাদের দেশে উৎপাদিত সম্পদগুলোকেই যদি আমরা সঠিকভাকে পরিচালনা করতে পারি ; তাহলে আমাদের জন্য আমাদের দেশের সম্পদই যথেষ্ঠ।

সুলতান মাহমুদ আরিফ, শিক্ষার্থী: সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ