সংবাদপত্রের জবাবদিহিতা এবং মফস্বল সাংবাদিকতা

  • আবুল বাশার শেখ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০, ০২:১৩ পিএম

ঢাকা : সংবাদপত্র  ফোর্থ এস্টেট— কথাটির গুরুত্ব অনেক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ঘটে যাওয়া জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়— অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনাবলির সরেজমিন প্রতিবেদন জনগণের সামনে উপস্থাপনের দায়িত্ব সংবাদপত্রের।

সরকারের ভালো-মন্দ, উন্নয়ন, দুর্নীতি— সবকিছু ইতিবাচক অর্থে জনসমক্ষে তুলে ধরাই সংবাদপত্রের একমাত্র কর্তব্য বলেই বোধ হয়। আর এ জন্যই সাংবাদিকগণ নির্ভীক চিত্তে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে সত্য ও ন্যায়ের পথে সচল রাখেন তার কলমকে। এক্ষেত্রে মফস্বল সাংবাদিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে শুরু থেকে।

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ও ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে তাতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মফস্বল সাংবাদিকতার অবদানও কম নয়। প্রতিনিয়ত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি তার কর্ম এলাকার অবহেলিত, উন্নয়নবঞ্চিত জনপদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। খুন, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, অশিক্ষা, অপচিকিৎসা, যৌতুক, গ্রামের সরল মানুষদের নানাভাবে প্রতারিত হওয়া, জবরদখল, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দলাদলি, অগ্নিকাণ্ড, পাহাড়ধস, বিদ্যুতের লোডশেডিং ইত্যাদির শিকার হওয়া মানুষগুলোর পক্ষে কথা বলেন।

দুর্ঘটনা, উন্নয়ন, অনিয়ম, খেলাধুলা, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন প্রকার সংবাদ পরিবেশন করে থাকেন। পত্রিকার হেড অফিসগুলোতে বিভাগভিত্তিক আলাদা আলাদা রিপোর্টার থাকলেও মফস্বল সাংবাদিকদের মধ্যে কোনো বিভাগ ভাগ করা নেই, তাই তাদের প্রতিটি বিষয়েই সংবাদ ও প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়। এতে করে তার দক্ষতাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। মফস্বল সাংবাদিকরা চতুর্মুখী যে শ্রম দেন তার বিনিময়ে তারা তেমন কিছুই পান না।

যারা সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে বেতনভাতা পান, তাদের বেতনভাতা বৃদ্ধি ও যাদের বেতনভুক্ত করা হয়নি তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি সাংবাদিক নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ন্যূনতম স্নাতক হওয়া উচিত। এর ফলে অপসাংবাদিকতা রোধ করা সম্ভব হবে।

তবে এটাও ঠিক যে সঠিক প্রশিক্ষণ, পেশাদারিত্বের অভাব, অধিক টাকার লোভ ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সাংবাদিকদের মাঝে বিভক্তি বাড়ছে। অপরদিকে অনেক সময় সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে সাংঘাতিক, হলুদ সাংবাদিক, চাঁদাবাজ সাংবাদিক, সিন্ডিকেট সাংবাদিক, বিজ্ঞাপন সাংবাদিক, রাজনৈতিক সাংবাদিক, গলাবাজ সাংবাদিক, ক্রেডিট পরিবর্তন সাংবাদিক, দালাল সাংবাদিক ইত্যাদি নেতিবাচক ভাষায় অভিহিত করা হয়। এর অবসান হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পত্রিকা ও মিডিয়াগুলোর কর্তৃপক্ষের স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা পরিত্যাগ করে কর্মদক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। পাশাপাশি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানোও প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, তথ্য বাণিজ্য নয়, দরকার তথ্য সেবা। তাই এক্ষেত্রে মফস্বল সাংবাদিকদের সাংবাদিকতার বুনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ পেশাভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

মফস্বল সাংবাদিকদের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত। সুতরাং তাদেরকে নিবেদিতপ্রাণ, পরিশ্রমী, সময়ানুবর্তী, সাহসী, কৌতূহলী, বুদ্ধিদীপ্ত, প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, ধৈর্যশীল, এবং রস ও সাহিত্যবোধ সম্পন্ন হতে হবে।

অধিক পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে পেশা কিংবা নেশা হিসেবে নেওয়া সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীরা এই গুণাবলি চর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সফল সাংবাদিক হওয়ার পথে এগিয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। এছাড়া পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখাটাও জরুরি। জনগণ চায়, সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতার অবসান হোক।

‘একটি ভালো সংবাদপত্র নিজেই দেশের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে’ সাংবাদিক আর্থার মিলারের এ কথা আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আমরা চাই, সাংবাদিকদের লেখনী সমাজের আয়নায় পরিণত হোক, যা দেখে সমাজের মানুষ সচেতন হবে। পাশাপাশি অপরাধমূলক সংবাদ পড়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে যাতে সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। এলাকার অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনা, শোষণের বিপক্ষে সাংবাদিকের কলম ও ক্যামেরা যথাযথ কাজ করুক ও ভালো কাজের প্রশংসার বাস্তবচিত্র ফুটে উঠুক, মফস্বল সাংবাদিকতার দ্বারা সমাজ উপকৃত হোক।

গ্রামবাংলার কল্যাণে মফস্বল সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। তাই গ্রামীণ তথা মফস্বল সাংবাদিকদের উপেক্ষা করে কোনো সংবাদপত্রই সফল অবস্থানে পৌঁছতে পারবে না। কিন্তু যেসব মফস্বল সাংবাদিক দেশের ৮৫ ভাগ মানুষের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অভাব-অভিযোগের খবর প্রত্যন্ত  অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে পত্রিকায় পাঠিয়ে থাকেন, তাদের খোঁজখবর পত্রিকার মালিক/সম্পাদক একটু কমই রাখেন। আবার এমন কিছু সংবাদ আছে যা সংগ্রহ করতে গেলে স্থানীয় প্রশাসনের পরোক্ষ হুমকি, প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানি, এমনকি প্রাণনাশের মতো আশঙ্কাও থাকে। তারপরও থেমে নেই মফস্বল সাংবাদিকদের পথ চলা। তবে এখন সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের মানোন্নয়ন হয়েছে নিঃসন্দেহে।

আগে মফস্বল সাংবাদিকদের সংবাদ পাঠাতে ৩০/৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো ফ্যাক্স করার জন্য। আর এখন হাতের মুঠোয় সব যোগাযোগ। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে সাংবাদিকতা অনেক সহজ হয়েছে। কদর বেড়েছে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের। বর্তমানে সাংবাদিকতার ধরন পাল্টেছে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। এখন আর প্রিন্ট হওয়া সংবাদপত্রের খবরের জন্য কেউ বসে থাকে না। মানুষ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো মুহূর্তের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রেও কিন্তু মফস্বল সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। সাংবাদিকরা বের করে আনেন খবরের ভেতরের খবর। এ কারণে সংবাদপত্রগুলো এখন মফস্বল সংবাদের গুরুত্ব অনুধাবন করছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বাইরের খবরে আজকাল বৈচিত্র্য এসেছে। মফস্বল সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয়েও প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। সাংবাদিকদের এ সুযোগ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)। আশা করি পিআইবি এই ধারা অব্যাহত রেখে তাদের কার্যপরিবেশ আরো প্রসারিত করবে। বর্তমানে তাদের পরিচালিত অনলাইনে ঘরে বসে সাংবাদিকতার বেশ কিছু কোর্স মফস্বল সাংবাদিকদের অনেক উপকারে এসেছে। রাজধানী এবং বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরেও আজকাল জেলা শহরগুলো থেকে অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাদের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এরা মূলত পাঠকনির্ভর নিজ শহরে ও আশেপাশের মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছে।

মফস্বল সাংবাদিকদের মধ্যে দু-একজন যে অপসাংবাদিকতা বা অপসাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত নেই, তা বলা যাবে না। এসব হলুদ সাংবাদিকের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এসব অপসাংবাদিকতা যদি রোধ করা না যায়, তবে খুব অল্পদিনেই সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের যে আস্থা রয়েছে, তা হারিয়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে, সরকার ও জনগণের সচেতনতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রকৃত সাংবাদিকদের নীতিবোধ ও সৎ মানসিকতা। পাশাপাশি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন।

শুরুতেই বলেছি রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে সংবাদপত্র। এই ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাই বিধ্বস্ত হবে। ন্যায়বিচার, সুশাসন ও উন্নয়ন গতি হারাবে। সাংবাদিকের কলম ন্যায়ের প্রতীক হয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দল-মত নির্বিশেষে সকলের ভুলত্রুটি শুধরে নিতে সাহায্য করে। আলোচনা-সমালোচনার ভেতর দিয়ে জাতীয় সব ইস্যু মীমাংসায় পথ দেখায় এবং সর্বস্তরের রাজনীতিকেও পরিশুদ্ধ করে তুলকে সহায়তা করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় রাখতে সংবাদপত্রের ভূমিকাকে অস্বীকারের উপায় নেই। সুতরাং সংবাদপত্রের স্বাধীন মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা দূর করে সাংবাদিকদের কলমকে মুক্ত ও সচল রাখতে দলমত নির্বিশেষে পরমতসহিষ্ণুতাও কাম্য। বিশেষ করে মফস্বল সাংবাদিকতাকে নিষ্কণ্টক করতে বর্তমান সময়ে এই গণতান্ত্রিক চর্চার ধারা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক
abasharpoet@gmail.com