একুশের শহীদ মিনার এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

  • রহিম আবদুর রহিম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০, ০২:৫৪ পিএম

ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সায়েন্স এনেক্স ভবন, মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের মধ্যবর্তী এলাকায় বিশাল বেদি ও ছয়  স্তম্ভসংবলিত আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই শহীদ মিনার জাতির সকল আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। একুশের কাকডাকা ভোরে লাখ মানুষের পদচারণায় যে প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে মুখরিত, সে প্রাঙ্গণ সব জাতীয় ইস্যু ও উৎসবে থাকে উদ্বেলিত।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যেসব বীর ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর গুলির আঘাতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটি রঞ্জিত করেছিলেন, তাদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে, প্রথম শহীদদের রক্ত যেখানে ঝরেছে সেই স্থানে ’৫২-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ছাত্ররা একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন, যা পরে শহীদ মিনার হিসাবে ইতিহাসে সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু ভীত প্রশাসন ২৬ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী দিয়ে শহীদ মিনারটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অবশিষ্ট থাকে শুধু একটি ব্লকের বেড়ায় আটকানো একটি পোস্টার- ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা এর যত মূল্য সে কি ধরায় ধুলায় হবে হারা।’

মহান একুশের কবিতা রচিত হয়েছিল তাৎক্ষণিক আবেগে। কিন্তু ওই সময় প্রয়োজন ছিল গানের। তাই একটি কবিতাকে করা হয় গান। আবদুল গাফফার চৌধুরীর কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’- এই কবিতাটি প্রথম আবৃত্তি করা হয় ধূপখোলার মাঠে, যুবলীগের এক উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে। পরে এই কবিতার প্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। আবদুল লতিফের সুরে গানটি প্রথম পরিবেশিত হতে থাকে আতিকুল ইসলামের কণ্ঠে। এরপর আলতাফ মাহমুদ গানটি নতুন করে সুরারোপ করেন। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি গীত হচ্ছে।

১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর ’৫৬-তে আবু হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে একুশে ফেব্রুয়ারির সকালবেলায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন- এ সংবাদ তাৎক্ষণিক ছাত্র-জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমনকি মিনার এলাকায় ছাত্র-জনতার ঢল নামে। উপস্থিত জনতা মিনার এলাকায় এসেই দেখতে পান, জনৈক পূর্তমন্ত্রী মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু বিপুলসংখ্যক জনতা এতে প্রবল আপত্তি জানান। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রিকশাচালক আওয়ালের ৬ বছর বয়স্ক কন্যা বসিরনকে দিয়ে জনতা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায়।

কিন্তু সরকারি আনুষ্ঠানিকতায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মাতা হাসিনা বেগম। উল্লেখ্য, আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে আবু হোসেন সরকার জুতা পায়ে আগমন করলে উপস্থিত জনতা ক্ষেপে যান। পরে তিনি জুতা খুলতে বাধ্য হন। যার কারণে পরে কেউ জুতা পায়ে মিনারের বেদিমূলে যেতে সাহস পায়নি। এখনো এ রেওয়াজ যথারীতি চলছে।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আইন সভায় ‘বাংলা একাডেমি অ্যাক্ট-১৯৫৭’ পাস করা হয়। ওই সময় শহীদ মিনারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে তদানীন্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ার এম এ জব্বারের ওপর। জব্বার সাহেব এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তখন  লন্ডন ফেরত শিল্পী হামিদুর রহমানকে মিনারের একটি মডেল তৈরি করতে বলেন।

প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গৃহীত শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ’৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং একটানা কাজ চালিয়ে ’৫৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের মূল বেদি এবং তিনটি স্তম্ভ তৈরি সমাপ্ত হয়।

এরপর ’৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান পরিকল্পিত মিনারটি পুনর্নির্মাণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মাহমুদ হোসেনকে সভাপতি করে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদ মিনারটি স্থাপন করার সুপারিশ করলে তা পুরোপুরি কাজে লাগে না। ছোট আকারে ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয়। ’৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত এই শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করেন শহীদ আবদুল বরকতের বাহাত্তর বছর বয়স্কা মাতা হাসিনা বেগম। ১৯৬৩ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত এই মিনার বাঙালির সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহূত হয়।

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর একপর্যায়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ২৬ ও ২৭ মার্চ ভারী গোলাবর্ষণ করে শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়। স্বাধীনতার পরে ’৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রথম শহীদ দিবস পালন করেছিলেন ওই ভাঙা শহীদ মিনারেই।

১৯৭২-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সভাপতি করে শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি কেবলমাত্র স্থপতিদের কাছ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নকশা ও পরিকল্পনা আহ্বান করেন।

শিল্পী হামিদুর স্থপতি ছিলেন না বলেই তিনি বিশিষ্ট স্থপতি এম এস জাফরের সঙ্গে মিলিতভাবে একটা সংস্থা গঠন করে নকশা প্রণয়ন করেন। সরকারি অনুমোদন থাকলেও ওই সময় তাদের তৈরি মডেলে শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। এরশাদ আমলে এই মডেল অনুযায়ী বর্তমান শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।    

জাতীয় শহীদ মিনার নির্মাণের ক্ষেত্রে মডেল যথাযথ অনুসরণ এবং তা সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। সবচেয়ে বড় কথা এখনো শহীদ মিনার আঙিনায় বিদেশি ভাষায় স্লোগান চলছে।

কোনো দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নয়; বলতে চাচ্ছি, ‘জিন্দাবাদ’— এই শব্দটি যেমন বিদেশি শব্দ, তেমনি ‘জয় বাংলা’ শব্দটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার স্বাক্ষর। অথচ আমরা ভাষা আন্দোলনের মূল শক্তি বা অর্জনটিকে বর্জন করে রাজনৈতিক সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছি। ডানপন্থি, বামপন্থি, মধ্যপন্থি সবাই আমরা মাতৃভাষার চেতনা থেকে দূর বহুদূরে অবস্থান করছি। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় লেখার নির্দেশনা আসে।

বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা সন তারিখ লেখার রিট আবেদন উচ্চ আদালতে হওয়া, বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত সুখবর। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্লোগানও বাংলায় হোক, অর্থাৎ ‘জিন্দাবাদ’ মার্কা কথাবার্তা আমাদের সব ধরনের স্লোগান থেকে দূরীভূত হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনামাখা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঐতিহাসিক চরণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি আজ জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে এটাই বাঙালির জন্য স্বস্তির বিষয়।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন জাতীয় ইস্যুভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোতে ‘জয় বাংলা’ বলার যে নির্দেশনা, সেটি আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধিকার আন্দোলনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিসংগ্রাম; এমনকি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ’৯০-এর ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান— বাঙালির এসব অর্জন ও প্রাপ্তি আজ রক্ষা করতে হবে আমাদের আগামী প্রজন্মকেই। সেই অর্থে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও গড়ে তুলতে হবে শুদ্ধ মাতৃভাষার চর্চা ও স্বদেশপ্রেমে জাগরণের ভেতর দিয়েই। আর এ কাজটি করতে হবে আমাদেরই।      

লেখক : নাট্যকার ও শিশু সংগঠক