করোনা আতঙ্ক

আমরা কবে মানুষ হব

  • মোজাম্মেল হক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ১, ২০২০, ০৪:০৫ পিএম

ঢাকা : সারা বিশ্ব এখন করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) আতঙ্কে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ ভয়াল ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। ইতোমধ্যে ১৯০-এর অধিক দেশ আক্রান্ত হয়েছে এ ভাইরাসে।

এদিকে এই ভাইরাসটিকে মানবতার শত্রু আখ্যা দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বাংলাদেশও বাদ যায়নি এ ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনসমাগম বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাদারীপুরের শিবপুর উপজেলাকে ‘লকডাউন’ করা হয়েছে।  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইইডিসিআর থেকে প্রতিদিন বলা হচ্ছে সচেতন থাকতে এবং কোনো প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বাইরে না যেতে। আমরা করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত ঠিকই, কিন্তু এখনো সচেতন নই! জাতি হিসেবে এ আমাদের দুর্ভাগ্য।

মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ সৃষ্টিকর্তা অন্য কোনো প্রাণীকে বিবেক নামক জিনিসটি দেননি,  যা মানুষকে দিয়েছেন। মানুষ নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে কাজ করে বলেই তার এত শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু যখন আমরা বিবেকবহির্ভূত কাজ করি তখন কি আমরা মানুষ থাকি? আমাদেরকে কি তখন মানুষ বলা যাবে? এখনো আমরা ‘হুজুগে বাঙালি’ এই আপ্ত বাক্যটির প্রমাণ দিয়ে চলেছি পদে পদে।

করোনা আতঙ্কে যখন সারা বিশ্বজুড়ে হাহাকার, বাংলাদেশে বসবাসরত আমরাও আতঙ্কগ্রস্ত এবং করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরোধমূলক দ্রব্যাদি অর্থাৎ মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনতে যাচ্ছি; তখন একদল বিবেকবহির্ভূত অসাধু ব্যবসায়ী এসব মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম প্রায় ১০-১৫ গুণ বাড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করল। সাধারণ জনগণ ১০ টাকার মাস্ক ১০০ টাকায় ক্রয় করতে বাধ্য হলো। বিশ্বের সভ্য দেশগুলো যখন  দুর্যোগ ও মহামারীতে সাধারণ সময় থেকে কম দামে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রয় করার চেষ্টা করে থাকে, সেই তখন আমাদের দেশে ঘটে ঠিক তার উল্টোটাই। আমাদের দেশে এমন সময় একটি সিন্ডিকেট পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং চড়া দামে তা বিক্রয় করে থাকে। এখন যখন দেশে করোনা ভাইরাস কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ স্তরে পৌঁছে গেছে, দেশে দিন দিন যখন করোনা মহামারীর হুমকি নিয়ে আসছে, এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম রাতারাতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি কি বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষের কাজ? তবে আশার কথা, এবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে জোর তৎপরতা। ফলে দেখা যাচ্ছে, অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জেল-জরিমানা করতে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রবাসীগণ যারা সম্প্রতি বিদেশফেরত এবং করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন দেশ থেকে এসেছেন। তাদেরকে বলা হলো— পরিবার, সমাজ ও দেশের স্বার্থে আপনারা অন্তত ১৪ দিন ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ থাকুন। এতে করে ঐ ব্যক্তি যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তও হয়ে থাকে তাহলে তার থেকে তার পরিবারের সদস্য বা অন্য কারো আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। কিন্তু প্রবাসীরা তা মানছেন না। তারা পরিবারের সঙ্গে একত্রে থাকছেন, অনেকে জমজমাট আয়োজন করে বিয়ে করছেন,  কেউবা বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করছেন আবার অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বা যত্রতত্র বেড়াতে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে যতগুলো রোগী পাওয়া গেছে তার সিংহভাগই হয় প্রবাসী নতুবা প্রবাসীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই যে তাদের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াচ্ছে, এতে কি তাদের কোনো দায় নেই? কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ কি এ কাজ করতে পারে? এক্ষেত্রে তাদেরও কি মানুষ বলা যাবে?

আবার আরেকটি জিনিস আমাদের আতঙ্ককে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা হলো গুজব। আমরা হুজুগে বাঙালি, কোনো কিছু বিচার বিশ্লেষণ না করেই গুজব গ্রহণ করি এবং আরো বেশি করে ছড়িয়ে দেই। আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে গুজব। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংগঠনের বরাত দিয়ে মিথ্যা গুজব রটানো হচ্ছে। এমনকি স্বপ্নে দেখা করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির ওষুধ আবিষ্কারের গুজবও আমরা অতি উত্তেজনার সঙ্গে ছড়াচ্ছি। আমরা এসব ব্যাপার নিয়ে সচেতন হচ্ছি না, কেউ কথা বলছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা ঘরে থাকে, বাইরে বের না হয়। আমরা কি করছি? এই জরুরি অবস্থায় বন্ধ পেয়ে পর্যটন স্থানগুলোতে ভিড় করছি। কবিগুরু হয়তো এ কারণেই রাগ করে বলেছিলেন— ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’

এখন আমাদের উচিত হবে যেহেতু করোনা ভাইরাস বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করেছে, এজন্য শুধুই আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্তা গ্রহণ করা। নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যকে সচেতন করা। সবাই সবার জায়গা থেকে দেশের নাগরিক হিসেবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটাই বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি। অন্তত এ মহা দুর্যোগের সময় ফায়দা লোটার আশায় আমরা যেন বিবেকবহির্ভূত কাজ না করি। একমাত্র আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারবে বিশ্বকে মরণঘাতী ‘করোনা’ নামক এই মানবতার শত্রু থেকে রক্ষা করতে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়