জীবন বীমা কোম্পানির আর্থিক বিবরণী প্রসঙ্গে

  • মো. নূ র - উ ল আ ল ম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২০, ০২:০৬ পিএম

ঢাকা : সারা বিশ্বে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোতে হিসাব সংরক্ষণ এবং জনগণের সামনে তা প্রকাশ করার বিষয়ে চূড়ান্ত হিসাব বা আর্থিক বিবরণী একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। আর্থিক বিবরণীর পাঁচটি অংশ রয়েছে— চারটি বিবরণী এবং অপরটি নোটস বা টীকাসমূহ। আমাদের দেশে সব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আর্থিক বিবরণীর পাঁচটি অংশই তৈরি করে এবং জনগণের সামনে তা প্রকাশ করে থাকে। অথচ বাংলাদেশে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো খণ্ডিতভাবে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে। অর্থাৎ তারা যথাযথভাবে আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করে না; তারা লাভ-লোকসান হিসাব তৈরি করে না। এ নিবন্ধে বীমা আইন ১৯৩৮ এবং বীমা আইন ২০১০, আইএফআরএস-৪ (বীমা চুক্তিসমূহ), আইডিআরএ সার্কুলার, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোতে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর লাভ-লোকসান হিসাব, প্রস্তুতিবিষয়ক ভাবনা, বাস্তবতা এবং এ বিষয়ে সম্ভাব্য সংস্কারের একটি সংক্ষিপ্ত সারনির্যাস উপস্থাপনের চেষ্টা থাকবে।

স্থিতিপত্র তথা ব্যালেন্স শিট বা স্টেটমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল পজিশন, ইনকাম স্টেটমেন্ট তথা আয় বিবরণী বা লাভ-লোকসান হিসাব এবং স্টেটমেন্ট অব চেঞ্জেস অব ওনার্স ইকুইটি তথা সাধারণ শেয়ারে পরিবর্তনের বিবরণী হলো একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর তিনটি অবিচ্ছদ্য অংশ। এছাড়া ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট বা নগদ বিচলন বিবরণী এবং ব্যালেন্স শিট বা স্টেটমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল পজিশনের টীকাগুলোও আর্থিক বিবরণীর অংশ হিসেবে হিসাব বিজ্ঞানীদের কাছে সমাদৃত। অতএব অতীতে চূড়ান্ত হিসাব বা হালে আর্থিক বিবরণী, যে নামেই ডাকি না কেন, লাভ-লোকসান হিসাব তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সকলে জানেন এবং মানেন। এটা হিসাবরক্ষণের এতটাই মৌলিক বিষয় যে, এ বিষয়টিতে কারোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। একটি হিসাব বছরে অর্জিত সকল আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য থেকে উক্ত বছরের নিট মুনাফা হিসাব করা হয়। যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে বণ্টনযোগ্য মুনাফা বের করা হয় ।    

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি প্রায় দু’শ বছর ধরে এদেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলো কোনো বার্ষিক লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুত করছে না। ফলে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো সঠিকভাবে তাদের বার্ষিক আয়-ব্যয় নির্ণয় করতে পারছে না। এতে একদিকে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে সঠিক মুনাফা বের না হওয়ায় ‘বিনিয়োগকারী’রাও বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য ডিভিডেন্ড থেকে। উপরন্তু সকল বীমা গ্রাহকও বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রাপ্য মুনাফা থেকে। সকলেই জানেন, বিনিয়োগকারীরা লাভ-লোকসান হিসাবের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সঠিক লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুতির অভাবে তাদের অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব হচ্ছে।

কোম্পানি আইন ১৯৯৪, বীমা আইন ২০১০ এবং সিকিরিটিজ এক্সচেঞ্জ রুল ১৯৮৭-এ পরিষ্কারভাবে সব পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির জন্য লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুতের নির্দেশনা রয়েছে। তাছাড়া আর্থিক বিবরণী বিষয়ে বিশ্বজনীন নিয়মকানুনগুলোও বেশ সুস্পষ্ট। আন্তর্জাতিক আর্থিক বিবরণী প্রকাশন মান-৪-এ জীবন বীমা এবং সাধারণ বীমাসহ সকল প্রকার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোর আয়বিবরণী প্রস্তুতি বিষয়ে সুস্পষ্ট মান বজায় রাখতে বলা হয়েছে। শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভারত এবং নেপালসহ আমাদের সব প্রতিবেশী দেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলো লাভ-লোকসান হিসাব করে। পিছিয়ে নেই বীমা জগতে নবীনতম দেশ মিয়ানমারও। অথচ আমরা রয়েছি সেই তিমিরেই।

স্বীকার করতে হবে যে, বীমা কোম্পানির আর্থিক বিবরণী অন্যান্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির চাইতে কিছুটা ভিন্ন। সবচাইতে বড় ভিন্নতা হলো এক্ষেত্রে রাজস্ব হিসাব বা রেভেনিউ অ্যাকাউন্ট নামে বাড়তি একটি হিসাব বিবরণী প্রস্তুত করতে হয়। দেশের সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করলে দেকা যায়, স্থিতিপত্র ছাড়াও তারা যেসব হিসাব প্রস্তুত করে তা হলো— লাভ-লোকসান হিসাব, মিলিত রাজস্ব হিসাব ও প্রডাক্ট অনুযায়ী আলাদা আলাদ রাজস্ব হিসাব, নগদ বিচলন বিবরণী, সাধারণ শেয়ারে পরিবর্তনের বিবরণী এবং টীকাসমূহ। অর্থাৎ দেশের সাধারণ বীমা কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর অংশ ছয়টি। কিন্তু জীবন বীমা কোম্পানিগুলো লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুত করছে না।

হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে যারা অতটা পরিপক্ব নয়, তাদের মনে হয়তো ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উদয় হতে শুরু করেছে যে, তাহলে আমাদের দেশে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো যা প্রস্তুত করে তা আসলে কী? মূলত আমাদের জীবন বীমা কোম্পানিগুলো রেভেনিউ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একটি দীর্ঘ মেয়াদি সলভেন্সি সারপ্লাস নির্ণয় করে থাকে। এ সারপ্লাস নির্ণয় করা হয়, লাইফ ফান্ড থেকে অনুমান নির্ভর বীমা দায় বাদ দিয়ে, অর্থাৎ বছর শেষে পুঞ্জীভূত লাইফ ফান্ড থেকে সারা বছরের আনুমানিক বীমা দায় বিয়োগ করে সারপ্লাস নির্ণয় করে তা রেভেনিউ অ্যাকাউন্টে দেখানো হচ্ছে। কোনো প্রকার লাভ বা লোকসান হিসাব প্রস্তুত করছে না। এত বড় অনিয়মের মূলে রয়েছে ব্রিটিশ ভারতের বীমা আইন ১৯৩৮-এর ধারা ১৩ যা বাংলাদেশে প্রণীত বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ৩০-এ হুবহু প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অথচ এ সারপ্লাস কখনোই বাৎসরিক পারফরম্যান্স বা লাভ নয়। বরং উক্ত সারপ্লাস হলো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্ণিত অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অর্জনের একত্রিত একটি রূপ যা কোনো কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সচ্ছলতাবিষয়ক একটি তথ্য মাত্র। লাভ কখনোই অনুমাননির্ভর হতে পারে না। এজন্যই চলতি বছরে সংঘটিত পারফরম্যান্সই হলো বিশ্বজুড়ে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর আয় নির্ণয়ের ভিত্তি। ফলে সেটিই করপোরেট টেক্সট নির্ণয়েরও ভিত্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত ধারণা। সারপ্লাসকে লাভ হিসেবে দেখানো তাই বাতিল ধারণা ছাড়া কিছুই নয়।

উপরন্তু বীমা আইন ২০১০-এর ধারা ২৭-এ সুস্পষ্টভাবে সকল বীমা কোম্পানিকে লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুতের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো বিষয়টি মেনে চললেও মানছে না জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। এ বিষয়ে আরো জানতে প্রতিবেশী দেশসমূহের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এইচএনএস ইন্স্যুরেন্সসহ শ্রীলংকার বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তারা আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতের ক্ষেত্রে সব আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখছে, অর্থাৎ লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুত করছে। অধিকন্তু কোম্পানিগুলো বার্ষিক প্রতিবেদনে অ্যাকচুয়ারিয়াল ভ্যালুয়েশনবিষয়ক অ্যাকচুয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেশন দর্শিত হয়েছে। রয়েছে ক্লেইম রিজার্ভবিষয়ক পৃথক অ্যাকচুয়ারি কর্তৃক স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেশন। অথচ বাংলাদেশে অ্যাকচুয়ারিরা সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে এ ধরনের কোনো প্রত্যয়নপত্র দান করছেন না। ফলে ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ শেয়ার মালিক, গ্রাহক এবং অপরাপর অংশীজনদের স্বার্থ।     

এর মাধ্যমে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে যথাযথ রাজস্ব থেকে। আমাদের জীবন বীমা কোম্পানিগুলো দাবি করে ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪-এর চতুর্থ শিডিউলে বর্ণিত সারপ্লাসের (যা কোনোভাবেই ফিট নয়) ভিত্তিতে তারা মুনাফা নির্ণয় করে এবং তদনুযায়ী ট্যাক্স দান করে। বিষয়টি আসলে তা নয়। বরং তা হলো তারা যা বলে তা পরিষ্কারভাবে ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪-এর অর্থকে  নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার। ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ শুধু বলেছে, জীবন বীমা কোম্পানির সারপ্লাস নির্ণয় করতে হবে বীমা আইন-২০১০-এ বর্ণিত অ্যাকচুয়ারিয়াল ভেলুয়েশনের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, অ্যাকচুয়ারিয়াল ভেলুয়েশনের ভিত্তিতে নির্ণীত বীমা দায় আমাদের আলোচ্য লাভ-লোকসান হিসাবেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। তদুপরি সারা বিশ্বের সব দেশে অ্যাকচুয়ারিয়াল ভেলুয়েশনের ভিত্তিতে  নির্ণীত উক্ত বীমা দায়কে লাভ-লোকসান হিসেবে দেখানো হয়। যার ব্যতিক্রম নয় আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোও।

তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, আমাদের দেশে জীবন বীমা কোম্পানিগুলো কেন লাভ-লোকসান হিসাব করছে না, কেন তারা শুধু রেভেনিউ হিসাব তৈরি করে তাদের দায় সারছে? এর মূলে আছে ২০১২ সালের ১১ জুনে ইস্যুকৃত আইডিআরএ সার্কুলার লাইফ-৪/২০১২ : হিসাব এবং আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতি বিষয়ক নির্দেশনা। যেখানে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য কোনো লাভ-লোকসান হিসাব প্রস্তুতির বিধান রাখা হয়নি। এ বিষয়ে উক্ত সার্কুলারে প্রদত্ত বীমা আইন ২০১০-এর ১৬০ ধারার যে উদ্ধৃতি দিয়েছে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। উক্ত সার্কুলারে বীমা আইনের ১৬০ (২) ধারার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, যেহেতু অদ্যাবধি বীমা আইন ২০১০-এর কোনো রুলস বা বিধিমালা জারি হয়নি, তাই নতুন আইনের ব্যাখ্যায় ১৯৩৮ সালের বীমা আইনের বিধিসমূহ (বীমা বিধিমালা ১৯৫৮) বহাল থাকবে। দুটি আলাদা আইন যা একটি অপরটিকে রিফিল করেছে, সেক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত আইনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যায় কি কখনো বাতিলকৃত আইনের রুল দিয়ে দেয়া সম্ভব? বিষয়টি আইন বিশেষজ্ঞদের আলোচনার ভালো একটি বিষয় হতে পারে। আইনের ছাত্র হিসেবে আমার বরং মনে হয়, বিষয়টি এমন হওয়ার কথা, যেসব বিষয়ে বীমা আইন ২০১০ বীমা আইন ১৯৩৮-এর অনুরূপ, সেসব ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখায় বীমা বিধিমালা ১৯৫৮ প্রযোজ্য হবে।

এক্ষেত্রে আপনাদের আরো মনে করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশে প্রণীত জাতীয় বীমা-নীতিতে বলা হয়েছে, আমাদের বীমা-নীতি হবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বীমা-নীতিসমূহের অনুরূপ। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা বীমা সংক্রান্ত তাদের মূল বিধি-বিধানসমূহ পেয়েছে ব্রিটেন থেকে। এসব দেশের জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ লাভক্ষতি হিসাব প্রস্তুত করছে। একমাত্র ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।

আগেই বলেছি, সারপ্লাস কোনোক্রমেই লাভ নয় বরং লাভ নির্ণয়ের অনুঘটক মাত্র। আশ্চর্যজনভাবে বাংলাদেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর প্রদর্শিত লাভের হার বিশ্ব গড়ের অর্ধেক। ফলে আমাদের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর করের হার বিশ্ব গড়ের প্রায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানিগুলো প্রদর্শিত স্বল্প রাজস্বের বিপরীতে কোম্পানিগুলোর প্রদত্ত করের পরিমাণ বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এতে একদিকে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে সঠিক মুনাফা বের না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরাও বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য ডিভিডেন্ড থেকে। উপরন্তু সকল বীমা গ্রাহকও বঞ্চিত হচ্ছে তাদের প্রাপ্য মুনাফা থেকে। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, আমাদের বীমা-নীতি নতুন করে পর্যালোচনার দাবি রাখে।

লেখক : সহযোগী সদস্য. ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)
csnoor.bd@gmail.com