সংবাদ ভাষ্য

ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনা প্রশ্নবিদ্ধ সুশাসন

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১১, ২০২১, ১২:০৭ পিএম

ঢাকা : গোটা দুনিয়ার সাথে বাংলাদেশও আজ ভয়াবহ করোনার কবলে আক্রান্ত। মাঝখানে ঘাতক করোনার মরণ ছোবল কিছুটা কমলেও থেকে থেকে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আবার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে, বিদেশ থেকে তৃতীয় মাত্রার ভয়াবহ করোনাভাইরাসের আগমন সংবাদ শুনে। এমনি এক মহাপ্রলয়ংকরী পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় জীবনের বৃহত্তম উৎসব ঈদুল ফিতর আসাতে অবস্থা প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, এমনকি লগডাউনও মানুষকে বেঁধে রাখতে পারছে না নিজ নিজ স্থানে। আবহমানকাল থেকে মানুষ পবিত্র ঈদ নিজ নিজ বাড়ি গিয়ে মা, বাবা, ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়-পরিজনের সাথে একত্রে উৎসবে মেতে ওঠে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এই উৎসবের সাথে মিশে আছে মৃত্যুঝুঁকি। আনন্দ করতে গিয়ে মানুষ লাশ হয়ে ফিরে আসুক এটা কারো কাম্য হতে পারে না। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি উপলব্ধি করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আবেদন জানিয়েছেন, বাড়ি-ঘরে না গিয়ে যার যার স্থানে অবস্থান করে প্রত্যেকে যেন ঈদ উৎসব পালন করে। তিনি এতটাই সচেতন ও শঙ্কিত যে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তারা যেন ঈদ উৎসব করতে গিয়ে ঘাতক করোনার বীজ বাড়ি নিয়ে না যায়। তারা যেন ঈদ উৎসব করার সাথে প্রিয়জনদের জন্য মরণ ডেকে না আনে।

এখানে আমাদের প্রশ্ন হলো, দেশের তাবৎ কাজ সবই কি একা প্রধানমন্ত্রীকে করতে হবে? করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এমতাবস্থায় এই মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়? জানতে ইচ্ছা করে-কারা এবং কোন বিচারে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও অন্য প্রকার যানবাহন আছে তারা রাস্তায় চলাচল করতে পারবে, দূর-দূরান্ত গমন করতে পারবে, আর অন্যদিকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলতে পারবে না। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করে সীমিত আকারে স্থানীয় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি পেলেও দূরপাল্লার গণপরিবহন, নৌচলাচল প্রভৃতি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। যারা এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে-যাদের নিজস্ব পরিবহন আছে তারা সর্বত্র বিচরণ করতে পারবে, তারা কি জানে না এই নির্দেশের মধ্যে ভয়ংকর ফাঁকফোকর রয়েছে। ঢাকা শহরেই হাজার হাজার রেন্ট-এ-কার সার্ভিস রয়েছে। তিন থেকে চার হাজার টাকা একটি কার ও সাত থেকে আট হাজার টাকা ভাড়ায় একটি মাইক্রোবাস সংগ্রহ করে দেশের সর্বত্র দূর-দূরান্ত যাতায়াত করা যায়। বর্তমানে পরিস্থিতিতে তাই হয়েছে। যারা সৌভাগ্যবান ও যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তারা ছাড়াও যেসব ভাগ্যবান আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা গাড়ি ভাড়া করে দূর-দূরান্ত চলে যাচ্ছে ঈদ উৎসব পালন করতে। শুধু উপেক্ষিত রয়েছে সাধারণ মানুষ-গরিব-দুঃখী দিনমজুর, কামার, কুমার, জেলে, রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িচালক, খেটে খাওয়া মানুষ। সৌভাগ্যবান ধনী ও সচ্ছল ব্যক্তিদের যেমন প্রিয়জন নিয়ে ঈদ উৎসবে মাতোয়ারা হওয়ার অধিকার আছে, তেমনি গরিব মানুষেরও আকাঙ্ক্ষা রয়েছে প্রিয়জনদের সাথে মিলেমিশে ঈদ করার। বরং এ প্রশ্নে গরিব মানুষই বেশি আবেগপ্রবণ। মা-বাবা, ছেলে-সন্তানদের সাথে ঈদ করা ধনীদের চেয়ে বরং তাদেরই বেশি স্পর্শকাতরতা রয়েছে।

আমরা দেশে সুশাসন চাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সুশাসনের বিষয়ে তিনি অতীব সজাগ ও সক্রিয়। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত নিল যাদের গাড়ি আছে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে, নির্বিচারে, নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে আর গরিব-দুঃখী মানুষ রাস্তায় রাস্তায়, বাস টার্মিনালে, লঞ্চঘাটে, ফেরিঘাটে অমানবিক অবস্থায় ছটফট করবে; সেইসব হোমরাচোমরা, মন্ত্রী-যন্ত্রী-তন্ত্রীগণও ভেবেছেন এই সিদ্ধান্ত চরম বৈষম্যমূলক। এই সিদ্ধান্ত সুশাসনের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেছে। এই সিদ্ধান্ত সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফেরিঘাটের দৃশ্য দেখলে বিবেকবান ব্যক্তিদের হূদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কখনো বলা হচ্ছে ফেরি চলাচল নিষেধ রয়েছে, কখনো বলা হচ্ছে মানবিক বিষয়ের দিকে লক্ষ রেখে সীমিত আকারে ফেরি চলাচলের অনুমতি রয়েছে। সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, টেলিভিশন চ্যানেল থেকে আইডব্লিওটিএ’র চেয়ারম্যান মহোদয়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কর্তৃপক্ষ কি পূর্ব থেকে জানত না এমন দুর্বিষহ মানবিক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে? উত্তরে তিনি বলেন, আমরা মুন্সীগঞ্জ ও মাদারীপুরের ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছি বিষয়টি দেখাশোনা করার জন্য। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিজিবি নামানো হয়েছে। আমি টিভি পর্দায় দেখেছি, একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে দরজা ফাঁকা করে একজন মহিলা চিৎকার করে বলছেন, আমার মা মারা যাচ্ছে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির আশায় বসে আছি। আমি কি আমার মৃত্যুপথযাত্রী মাকে নদীতে ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যাব? আমি আইডব্লিওটিএ’র চেয়ারম্যান মহোদয়কে বলতে চাই, দ্রুত ও পর্যাপ্ত ফেরির ব্যবস্থা না করে আপনি বিজিবি দিয়ে এই মানবিক সমস্যার কি সমাধান করার জন্য ডিসি মহোদয়দের নির্দেশ দিয়েছেন? আসলে আপনারা কোন কোন সময় পরিস্থিতির কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে তা বুঝবেন না কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন। ফলে পরিস্থিতি যখন আয়ত্তের বাইরে চলে যায় তখন গোটা দায়দায়িত্ব পড়ে সরকারের ওপর। এই ব্যর্থতার ভার পোহাতে হয় সরকারকে ও সরকারপ্রধানকে। লক্ষ রাখবেন, আপনাদের কারো কারো সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের অভাব কিংবা ব্যর্থতা যেন জনগণের মধ্যে ব্যাপক গণরোষ সৃষ্টি না করে। জনরোষ সৃষ্টি হলে অনেক কিছুই পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আমাদের জাতি এমন অবস্থা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট