আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি বিএনপির তৃণমূলে

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০১৬, ১২:০২ পিএম

বিএনপির ঘরছাড়া নেতাকর্মীদের আতঙ্ক কাটেনি এখনও। ইউনিয়ন নির্বাচনের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতে দেশজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযানে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে বিএনপির তৃণমূল।

সরকারবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ সময়ের পর এসব নেতাকর্মীর মাঝে ক্ষণিকের জন্য স্বস্তি ফিরলেও এখনো গ্রেফতার আতঙ্কে ঘরছাড়া দলটির তৃণমূল নেতৃবৃন্দ। অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা না থাকলেও পেন্ডিং মামলার খড়গ নেমে আসছে তাদের ওপর। অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে দেশজুড়ে কয়েক হাজার মামলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। ঈদের আগে এ ধরনের সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার আতঙ্কে ঘরছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীদের পরিবার-পরিজনের মধ্যেও হতাশা নেমে এসেছে।

বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে গ্রামগঞ্জের সাধারণ নেতাকর্মীদেরই বেশি টার্গেট করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, সে সব নেতাদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ছাড়া যারা একাধিক মামলার আসামি তাদের মধ্যেও গ্রেফতার, গুম ও ক্রসফায়ার ভয় বিরাজ করছে। ফলে পবিত্র রমজান মাসেও এসব নেতাকর্মী আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জেলা পর্যায়ের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে সরে পড়েছেন।

সামনে পবিত্র ঈদও তাদের ভাগ্যে জুটবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। আর যেসব নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন তাদের পরিবার থানা পুলিশ আর আদালতপাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের শেষ অবলম্বনটুকু শেষ করে দিচ্ছেন। এসব পরিবারের ঈদ আনন্দ এখন নিরানন্দে পরিণত হয়েছে বলে নেতাকর্মীরা জানান।

বিএনপির পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, জঙ্গিবাদবিরোধী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা। সপ্তাহব্যাপী এ অভিযানে সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজার গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। একইভাবে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নেতাকর্মী আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে।

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, ২০১৫ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলন শেষে একটু স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসার পরপরই দেশজুড়ে ৬ ধাপে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা আর মামলা-হামলায় জর্জরিত হয়ে পড়ে তৃণমূল বিএনপি। অনেকেই এ সময়ে আহত-নিহত কিংবা মামলায় এলাকাছাড়া হয়ে পড়েন। এরপর সারাদেশে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে আরো বেকায়দায় পড়েন তারা। ফলে এ দফায়ও তারা পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। শহরমুখী এসব নেতাকর্মী রমজান মাসে জীবিকার টানে কায়িক পরিশ্রমও করছেন। কবে নাগাদ তারা আবার সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে বাড়িতে ফিরতে পারবেন, মা-বাবা, স্ত্রী-পরিজনসহ একসঙ্গে বাস করতে পারবেন তা নিজেরাও বলতে পারছেন না।

দলটির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন পেন্ডিং মামলায় আটকের বিষয়ে পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এইচএম দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, এ উপজেলায় যেসব নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মামলা ছিল না। রাজনৈতিক পেন্ডিং মামলা ছাড়াও অন্যান্য মামলাতে গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়েছে। বিগত দিনের আন্দোলনে যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা তো আগেই এলাকা ছাড়া। আর যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ছিল না তাদেরও এবার টার্গেট করে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির এক নেতা জানান, অভিযান শুরুর পরই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন। সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর মধ্যম পর্যায়ের নেতারাও গাঢাকা দিয়েছেন। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই আত্মগোপনে। গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও গাঢাকা দিয়ে চলছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর থেকেই এলাকা থেকে ফোন আসা শুরু হয়েছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই নেতাকর্মী ও সমর্থককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই তবুও তাদের আটক করা হয়েছে। আর মামলায় যারা জামিনে আছেন তারাও গ্রেফতার থেকে বাদ যাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে গ্রেফতার অভিযানের নামে ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে।

বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাঁড়াশি অভিযানে কেবল আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বিচারে সাধারণ মানুষ ও নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রতিরাতেই বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে। অনেক নেতার বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে পরিবারের স্বজনদের হেনস্থা করছে। এভাবে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে বিএনপির নেতাকর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন।
দেশজুড়ে এ গ্রেফতার অভিযানের বিষয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বিএনপি।

দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ সাঁড়াশি অভিযান বন্ধ আর বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের হয়রানি বন্ধে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপও কামনা করেন। তিনি বলেছেন, সাঁড়াশি অভিযানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা না হলেও তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। চাপে রাখতে শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিবদের বাড়ির সামনে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক নেতার ব্যক্তিগত চলাচলের বিষয়টিও সাদা পোশাকের পুলিশ নজরদারির মধ্যে রেখেছে। এভাবে নেতাদের চাপে রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, পবিত্র রমজান মাসেও সরকার দয়া-মায়া, মানবতা, আইন-কানুন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাসহ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্যই এই নির্বিচারে গণগ্রেফতারের নামে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি