ঢাকা: ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করার এক দশক পূর্তিতে আত্মদহন বেড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি)। দেশব্যাপী ব্যর্থ আন্দোলন-সহিংসতার দায় কাঁধে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে দলটিকে। ক্ষমতার সোনালী দিগন্তের হাতছানি স্মৃতিকাতরতা বাড়িয়ে দিয়েছে নেতাদের।
দলের বিপর্যস্তকর এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের অনুসারীরা। যারা এক সময় দলে সুপার পাওয়ার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাদের এ অবস্থার জন্য দায়ী দলে সৃষ্ট দুটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মধ্যে একটি নেতানির্ভর, আরেকটি আমলা কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট।
সূত্রমতে, বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন বিশেষ সহকারীর নেতৃত্বে সাবেক আমলা নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। আর অন্যটি গড়ে উঠেছে স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সমন্বয়ে। যাকে বলা হচ্ছে নেতানির্ভর সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, ওই দুই সিন্ডিকেটকে পেছন থেকে শক্তি জোগাচ্ছেন ঢাকার মহানগর বিএনপির একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। বর্তমানে এ সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছেন মধ্যম সারির নেতারাও। যারা সিন্ডিকেটের তল্পিবাহক হয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করে ফেলেছেন। তাদের অপকর্মের খবর এখন কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, এ দুটি সিন্ডিকেট দলকে বিভক্ত করে ফেলেছে। তাদের হাতেই পরিচালিত হচ্ছে যাবতীয় কার্যক্রম। আর তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় সংগঠন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে তারেক সমর্থকরা বলছেন, দুই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণকারীরাই দলের দ্বিতীয় নেতা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠদের দূরে সরিয়ে রাখছেন। বিশেষ করে যারা তারেক রহমানের সঙ্গে থেকে দিনের পর দিন তৃণমূলকে সংগঠিত করতে কাজ করে গেছেন তারা এখানে উপেক্ষিত।
একই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় তারেক রহমানের সঙ্গে থেকে তৃণমূলকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পর্যায়ের এক নেতা। তিনিও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বর্তমানে আপনারা যে বিএনপিকে দেখছেন, এটা আগের সেই বিএনপি নয়। মূলত বিএনপি এখন পরিচালিত হচ্ছে খণ্ড খণ্ড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এখানে যে যার সুবিধা মতো, নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটের লোকজন বেশ ভালোই আছেন। কারণ তাদের অর্থ-বিত্তের কোনো অভাব হচ্ছে না। তাই এরাই চায় না, বিএনপি ক্ষমতায় যাক।’
চেয়ারপারসনের ওই উপদেষ্টা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বিষয়ে লিখে কিছুই হবে না। কেননা, শক্তিশালী এসব সিন্ডিকেট ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ঠিকই নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। আর দলের ১২টা বাজাচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে দলকে।’
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর দফায় দফায় দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা তারেক ঘনিষ্ঠদের ভিন্ন বার্তা দিয়েছে। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এতো বেশি সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট কমিটি আর দেখেনি কেউ। অথচ এতো বড়ো কমিটিতে তারেক ঘনিষ্ঠ নেতাদের উপেক্ষা করে দলের মূল রাজনীতিতে তাদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে।
এই তালিকায় আছেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্তত তিনজন সদস্য, চারজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ছয়জন উপদেষ্টা। এ ছাড়া আগের কমিটির তিনজন যুগ্ম মহাসচিব, চারজন সাংগঠনিক সম্পাদক, দুজন সহসাংগঠনিক সম্পাদক, ১৩ জনের মতো সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং নবম জাতীয় সংসদে দলের এমপি ছিলেন এমন অন্তত ১১ জন এমপি কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
তারেক রহমানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন নেতার সংখ্যা অর্ধশতাধিক হবে। এরাই মূলত কেন্দ্রীয় রাজনীতির পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সাংগাঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছেন।
অবশেষে ওয়ান ইলেভেনে সময় দীর্ঘ কারাভোগের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তারেক রহমানকে বিদেশে যেতে হয়। এর মধ্যেই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে পরাজিত হয়ে সংসদে বিরোধী দল হয় বিএনপি। এরপর থেকেই দলের ভেতরে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে থাকেন তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এসব নেতারা। যার সর্বশেষ চিত্র ফুটে ওঠে দলটির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে। দফায় দফায় কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
তবে দলে সিন্ডিকেটের অস্তিত্বকে উড়িয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি বললেন, যারা সিন্ডিকেটের কথা যারা বলছেন, তারা আসলে দলের ভেতরে থাকা সরকারি এজেন্ট।’
মূলত, ১৯৯১ সালে ‘তরুণ নেতৃত্বের মডেল’ নিয়ে রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান। সে বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে চেয়ারপারসন মা বেগম খালেদা জিয়ার সহচর হিসেবে দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় অংশও নিয়েছিলেন। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে এসে তিনি স্বতন্ত্র প্লাটফরমে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। আর তখন থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন দলীয় রাজনীতিতে।
এক সময়ের দল ও সরকারের ‘পাওয়ার হাউজ’ হিসেবে পরিচিত ‘হাওয়া ভবনের’ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজনীতিকে মহাপ্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এরপর বিএনপি মূলত নবীন আর প্রবীণকেন্দ্রিক নেতৃত্বে অদৃশ্যভাবে বিভিক্ত হয়ে পড়ে। যার এক মেরুতে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, আরেক মেরুতে উদীয়মান নেতা তারেক রহমান। দলের ভেতরের সুক্ষ্ম এ বিভক্তি নেতাদের মধ্যে স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। দলে হঠাৎ করেই কোনো নবীনের মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠা ভেতরে ভেতরে মানতে পারছিলেন না প্রবীণরা।
সোনালীনিউজ/এমএন