৩৮ পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ

স্নায়ুচাপে অভিজ্ঞরা, টেনশনে নবীনরা

  • সুজন আকন/ মেহেদী হাসান, নিউজরুম এডিটর | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০১৬, ১০:৫৬ পিএম

ঢাকা: ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বর্ধিত কলেবরের ৮১ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়েছে ৪৩ পদের। বাকি ৩৮ পদের নাম ঘোষণা এখনও বাকি আছে। এর মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর তিন পদ, উপসম্পাদকে দুটিসহ সম্পাদকের সাত পদ আর সদস্যের ২৮ পদ অঘোষিত রয়েছে।

এসব পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ চলছে। অভিজ্ঞ ও প্রবীণ রাজনীতিকদের মধ্যে দেখা গেছে স্নায়ুচাপ। আর অপেক্ষাকৃত নবীন ও তরুণরা রয়েছে টেনশনে। সূত্রমতে, শনিবার (২৯ অক্টোবর) ও রোববারের (৩০ অক্টোবর) মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হতে পারে। হাতে সময় খুবই কম থাকায় পদ প্রত্যাশী নেতাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে পাল্লাপাল্লিভাব দেখা গেছে।

দলীয় সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় কমিটির পদ পেতে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা কয়েক মাস ধরেই চেষ্টা তদবির অব্যাহত রেখেছেন। পদপ্রত্যাশীরা প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। সম্মেলনকেন্দ্রিক সব কর্মসূচিতে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দিয়েছেন।

এদিকে, সম্মেলনের পর অর্ধেকের বেশি পদে নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় পদপ্রত্যাশীদের জায়গা খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। তাই বাকি পদগুলোতে নির্বাচিত হতে তারা শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন। সভাপতি ও সম্পাদকমণ্ডলীর বেশির ভাগ পদ পূরণ হয়ে যাওয়ায় অভিজ্ঞরা শেষ অবধি কার্যনির্বাহী কমিটিতে নিজেদের ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ জন্য সদ্য ঘোষিত কমিটির প্রভাবশালী নেতাসহ দলীয় প্রধানের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন দলের ধানমণ্ডির কার্যালয়ে। দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার নানা কর্মসূচিসহ দলীয় সব কর্মসূচিতে নিজেদের হাজির রাখছেন।

সূত্রমতে, সম্পাদকমণ্ডলীর মতো কেন্দ্রীয় সদস্যপদেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। এ পদে বেশির ভাগই পুরনোরা স্বপদে বহাল থাকতে পারেন। সদস্যের দুটি পদ বাড়ানো আর আগের কমিটির পাঁচজন সম্পাদকমণ্ডলীতে পদোন্নতি পাওয়ায় কিছু পদ খালি হয়েছে। এসব পদে নতুনদের পাশাপাশি সম্পাদকমণ্ডলী থেকে বাদপড়া দুইজনও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।

নেতারা মতে, পদ পাওয়ার জন্য যে কারোরই প্রত্যাশা বা প্রচেষ্টা থাকতে পারে। তবে বাকি পদগুলোতে কে বা কারা আসবেন, সেটা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাই ঠিক করবেন। কারণ কাউন্সিলররা তাকে এই ক্ষমতা দিয়ে গেছেন। আর শেখ হাসিনা যোগ্য ও ত্যাগীদেরই পদে বসাবেন।

এদিকে গত ২৫ অক্টোবর কমিটি ঘোষণার সময় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলে অনেক পরিবর্তন আসছে। যারা জনগণের সঙ্গে আচরণ খারাপ করবেন, যাদের অপকর্মের কারণে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কমিটিতে আরো নতুন মুখ আসবে। নতুন রক্তসঞ্চালনও এখানে থাকবে।’

তবে সম্মেলনের পরদিন ২৪ অক্টোবর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে পরদিন সম্পাদকমণ্ডলীর ২২ পদের নাম ঘোষণা করা হয়। সে সময় তিনি আগের অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, এক সপ্তাহের মধ্যে কমিটি ঘোষণা করা হবে। আমরা সেটাই করতে চাই।’

এদিকে, কার্যনির্বাহী কমিটির ২৮ সদস্য মনোনীত করতে আগামীকাল শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকেই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এরপরই সভাপতিমণ্ডলী ও সম্পাদকমণ্ডলীর বাকি সদস্যসহ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হবে।

বলা প্রয়োজন, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতি দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনয়ন দেন। এর বাইরে উপদেষ্টা পরিষদ, জাতীয় কমিটি ও সহসম্পাদকের পদও রয়েছে। দলের গঠনতন্ত্রে এসব কমিটি নির্বাচনে দলীয় সভাপতিকে একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৪ জন সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ ২৭টি পদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি পদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কৃষি ও সমবায়, পরিবেশ ও বন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যুব ও ক্রীড়া, উপদপ্তর এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা পদে কারো নাম ঘোষণা করা হয়নি। এ ছাড়া রয়েছে ২৮টি সদস্যপদ।

জানতে চাইলে নতুন কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ সংগঠন। এ দলে অনেক যোগ্য নেতা রয়েছেন। তাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসার প্রত্যাশা থাকাটা স্বাভাবিক। এটাকে চেষ্টা-তদবির বলার কোনো সুযোগ নেই।’

হানিফ আরো বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুসারে সভাপতি সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনয়ন দেন। এ জন্য ২৮ অক্টোবর সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে এটা চূড়ান্ত করে ২৯ অক্টোবরের মধ্যেই কমিটি দিতে পারব বলে আশা করছি।’ এর আগে সভাপতিমণ্ডলীর বাকি তিনটি ও সম্পাদকমণ্ডলীর সাতটি পদও চূড়ান্ত হয়ে যাবে বলে তিনি আশা করেন।

প্রসঙ্গত, দুদিনব্যাপী ২০তম জাতীয় সম্মেলনের শেষদিনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ২১ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা টানা অষ্টমবারের মতো পুনঃনির্বাচিত হন। প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। ওই দিন সভাপতিমণ্ডলীর ১৪ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। তাদের মধ্যে সাতজন বিদায়ী কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তারা হলেন- সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফর উল্যাহ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে নতুন যুক্ত হয়েছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান, আবদুল মান্নান খান, রমেশ চন্দ্র সেন ও পীযূষ ভট্টাচার্য। তাদের মধ্যে নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুর রাজ্জাক, ফারুক খান ও আবদুল মান্নান খান বিদায়ী কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন।

প্রথম দিন চারটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের নাম ঘোষণা করা হয়। তিনটিতে পুরনোরাই বহাল আছেন। তারা হলেন- মাহবুব-উল-আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। নতুন করে যুক্ত হন বিদায়ী কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুর রহমান। কোষাধ্যক্ষ পদে আগের এইচ এন আশিকুর রহমানই বহাল রয়েছেন।

এদিকে ২৫ অক্টোবর সম্পাদকমণ্ডলীর ২২ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন স্বপদে বহাল আছেন। তারা হলেন- আইনবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মতিন খসরু, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মুহম্মদ আবদুল্লাহ, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সাত্তার, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ।

এ ছাড়া আগের কমিটিতে প্রথমে কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পেলেও পরে দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়া আবদুস সোবহান গোলাপ এবারও দপ্তর সম্পাদক হয়েছেন। আগের কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল হয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। আগের কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য থেকে এবার পদোন্নতি পেয়ে সম্পাদকমণ্ডলীতে এসেছেন চারজন। তারা হলেন- অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক টিপু মুন্সী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম।

সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আগের কমিটির ছয়জনই আগের পদে বহাল আছেন। তারা হলেন- আহমেদ হোসেন, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, বি এম মোজাম্মেল, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এনামুল হক শামীম ছাড়াও এ পদে নতুন যুক্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী। এ ছাড়া শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে শামসুন নাহার চাঁপা এবং স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক পদে নতুন মুখ হিসেবে এসেছেন রোকেয়া সুলতানা।

আংশিক ঘোষিত কমিটি অনুযায়ী সম্পাদকমণ্ডলী থেকে আগের কমিটির পাঁচজন ছিটকে পড়েছেন। তারা হলেন- অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক আ হ ম মোস্তফা কামাল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান নূর, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ভুঁইয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর উয়েশিং।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি আগে ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট হলেও এবার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে আটটি পদ বাড়িয়ে ৮১ করা হয়েছে। বৃদ্ধি পাওয়া পদগুলোর মধ্যে হচ্ছে- সভাপতিমণ্ডলীর চারটি, সম্পাদকমণ্ডলীর দুটি (একটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও একটি সাংগঠনিক সম্পাদক) এবং দুটি সদস্য।

সোনালীনিউজ/এমএন