পরাজয়ে ‘হতবাক’ বিএনপিতে আত্মবিশ্লেষণ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬, ১২:৫০ পিএম

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির কেন্দ্রীয় হাইকামান্ডের নির্দেশে ভেতরে ভেতরে শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। কারণ ফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় নাসিক নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। আর এই নির্বাচনের সমন্বয় কমিটির প্রধান আহ্বায়ক ও দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ‘নাসিক নির্বাচনের ফলাফল’ বাতিলের কোনো দাবি না জানালেও ভোটের ব্যবধানকে অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য করেছেন। 

এ ছাড়া নাসিক নির্বাচনে ফল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির মুখপাত্র ও দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বাহ্যিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের বাতাবরণ সৃষ্টি করে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সত্যিকার অর্থে গণরায়ের প্রতিফলন ঘটলে, আমরা (বিএনপি) সেটিকে শুভেচ্ছা জানাই।

এদিকে নাসিক নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ে হলেও বর্তমান সময়ে ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনা’ চলাকালে নির্বাচনটি ছিল ভিন্নমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকেই নানা জল্পনা-কল্পনা থাকলেও ‘নাসিক নির্বাচন’ দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করছেন বিএনপি-ঘনিষ্ঠ দুই বিশিষ্টজন। তাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, দলের ভোট নয়, ব্যক্তি জনপ্রিয়তায় ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী নাসিক নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, আইভী যখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন, তখনো জয়লাভ করেছেন। তার মানে আইভীর নিজস্ব একটা বিরাট ভোটব্যাংক আছে। ওনার সততা, নিষ্ঠা, ভদ্রতা এবং পিতার যে পরিচয় ছিল সব মিলিয়ে আইভীর নিজস্ব ভোট আছে। সেটা বিরাট ভোট, যেটা আওয়ামী লীগকে হারাতে পারে, এ রকম ভোট। সেই ভোট তার ছিল, এর সঙ্গে নৌকার কিছু ভোট যুক্ত হয়েছে। সেই তুলনায় বিএনপি বেশি ভোট পেয়েছে। সুতরাং এতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই, লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।

অন্যদিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, দুর্বল প্রার্থীর কারণে নির্বাচনে হেরেছে বিএনপি। তিনি বলেন, এখানে আমি মনে করি বিএনপিরও সবচেয়ে বড় শিক্ষার বিষয় আছে নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন থেকে। এ রকম সংঘাত এলাকায় বিএনপির ভালো প্রার্থী ছিল না, সত্যিকার অর্থেই ছিল না। 

বিএনপির হিসাব-নিকাশ : নাসিক নির্বাচনের সমন্বয় কমিটির প্রধান আহ্বায়ক ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই নির্বাচনের ফলাফল অপ্রত্যাশিত। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। যারা আমাদের পোলিং এজেন্ট ছিলেন এবং যাদের নির্বাচনে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আইভীর জয়ের পর গণমাধ্যমকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি প্রার্থীর পরাজয়ের নানা দিক তুলে ধরেন দলটির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমার নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতা ১৯৭০ সাল থেকে। কোথাও ব্যর্থ হইনি। এবারই ব্যর্থ হওয়ার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। শেষ খেলাটা কী হবে, এটা নিয়ে আমরা অবগত ছিলাম না। যখন কেউ অপকর্ম করে, একই কৌশলে পরবর্তী সময়ে আবার সেই অপকর্ম করে না। অজানা কৌশলের প্রশ্রয় নেয়। সেই অজানা কৌশলটি কী তা আবিষ্কার করতে হবে। এতে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক হবে।

স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, আমি লোকাল এজেন্টদের আবার ডাকব। যদি এমন কোনো কথা তাদের থেকে থাকে, যা নির্বাচনের আগে বলতে পারেনি, সে কথাও শুনব। আমাদের অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা ছিল কি না, তাও বের করার চেষ্টা করব।

মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান পরাজিত হলেও জয়ী হয়েছেন জেলার শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা। দুজনের মধ্যে সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিনের ছেলে গোলাম মোহাম্মদ সাদরিল ও জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমূর আলম খন্দকারের ছোট ভাই মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হন। এ ছাড়া সাবেক আরেক এমপি আবুল কালামের ছেলে আবুল কাউসার আশাও নির্বাচনে অংশ নেন। তবে তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এ তিন নেতাই ব্যস্ত ছিলেন ছেলে ও ভাইকে নিয়ে। ধানের শীষের মেয়র নিয়ে তাদের প্রচারণা ছিল লোক দেখানো। ভেতরে ভেতরে তারা আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে আঁতাত করেন বলে দলের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি বিএনপির : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে জয়ী করতে কারচুপির অভিযোগ এনে ‘বিচার বিভাগীর তদন্ত’ দাবি করেছে বিএনপি। গতকাল শুক্রবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী এ দাবি করেন। তিনি বলেন, বাহ্যিকভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ধানের শীষের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের কারচুপির অভিযোগ উড়িয় দেয়া যায় না।

প্রসঙ্গত, বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘সন্তুষ্টি’র কথা বললেও ‘ভোট গণনায় ত্রুটি’ হয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দলীয় প্রার্থীর দেয়া ওই বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে গতকাল (২৩ ডিসেম্বর) শুক্রবার নয়াপল্টনে বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, ধানের শীষের প্রার্থীর অভিযোগকে আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি। সে জন্য গত বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ, গণনা, ফলাফল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আমি বিএনপির পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাচ্ছি। 

রিজভী অভিযোগ করেন, নারায়ণগঞ্জের ১৭৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৪৪টির স্বাক্ষরিত ফলাফলের অনুলিপি বিএনপির এজেন্টদের সরবরাহ করা হয়নি। তিনি বলেন, ভয়ভীতির পরিবেশ বিদ্যমান ছিল- যার প্রতিফলন আমরা দেখলাম, ভোটকেন্দ্রে স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ২৫ ভাগ। সার্বিকভাবে স্থানীয় নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোট পড়ার কথা, তার চেয়ে উপস্থিতি ছিল অনেক কম। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে সারা দিন ভোটার উপস্থিতি নগণ্য দেখা গেলেও ফলাফলে দেখা গেছে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন ধরে ভোট দিতে দেখা গেছে। তাদের ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

রিজভী বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজিরবিহীন নিরাপত্তার আড়ালে রাতের অন্ধকারে কী ভূমিকা রাখা হয়েছে, তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। কারণ কারফিউয়ের মতো পরিস্থিতিতে কোনো কিছু জনগণের নজরদারিতে থাকার কথা নয়। ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্স, সিলের মতো ভোটের সরঞ্জাম ক্ষমতাসীনদের হেফাজতে থাকলে ‘জালিয়াতির যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে’। বিএনপির এই নেতা বলেন, সেনাবাহিনী থাকলে ক্ষমতাশালীরা সেই অনিয়ম করার সাহস পায় না।

অবশ্য সংবাদ সম্মেলনের পর উপস্থিত সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন করলে তার জবাব দেননি রিজভী।

অন্যদের মধ্যে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, আফরোজা আব্বাস, আবদুস সালাম আজাদ, অ্যালবার্ট পি কস্টা, মুনির হোসেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই