খালেদার মামলা নিয়ে অস্থিরতা বাড়ছে বিএনপিতে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭, ১১:৩৩ এএম

ঢাকা : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কিনা, এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে খোদ দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে। তারা মনে করছেন, বর্তমান সরকার একাধিক মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য করতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভিন্ন মামলার বিচারিক কার্যক্রম যতই শেষ দিকে যাচ্ছে, ততই দলের শীর্ষ নেতাদের মাঝে অস্থিরতাও বাড়ছে।

খালেদা জিয়ার সাজা হলে তার অনুপস্থিতিতে কে দলের হাল ধরবেন, তা নিয়ে দলীয় ফোরামে চলছে নানা ‘হিসাব-নিকাশ’। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ভবিষ্যতের সংকটকালে বিএনপির হাল ধরার দায়িত্ব কাকে দেবেন- এ বিষয়টি নিজেই ঠিক করবেন দলের চেয়ারপারসন। সংশ্লিষ্ট নেতাদের দাবি, এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে একটি ‘হোম ওয়ার্ক’ করে রেখেছেন দলীয় প্রধান। এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার বিচারের প্রসঙ্গ নিয়ে ইতিমধ্যে দুই দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে শুরু হয়েছে বাহাস। 

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দু’টির বিচারিক কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আরো বেশক’টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার পথে। চূড়ান্তভাবে এ সব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলেই কারাগারে যেতে হতে পারে খালেদা জিয়াকে। আর তার বড় ছেলে ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তাছাড়া লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমানের দেশে ফেরাও অনেকটা অনিশ্চিত। এ কারণে আপদকালীন সময়ে দল যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, সেটি মাথায় রেখেই ভবিষ্যৎ নানা পরিকল্পনা ঠিক করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। 

জানা গেছে, নবগঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে চলতি মাসের শুরুতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। এসব বৈঠকে অংশ নেয়া সিনিয়র নেতা এবং উপদেষ্টারা দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশদ আলাপ-আলোচনা করেন দলীয় প্রধানের সঙ্গে। তাদের ওই আলোচনায় বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার বিচারিক কার্যক্রম নিয়েও কথা হয়। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের অনপুস্থিতিতে কে দলের হাল ধরবেন এমন প্রসঙ্গ ধারাবাহিক এসব বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে। তবে সব বৈঠকেই খালেদা জিয়া সংশ্লিষ্ট নেতাদের আশ্বস্ত করেন, সেটা সময় এলেই জানানো হবে। 

বিএনপি চেয়ারপারসনের ধারাবাহিক এসব বৈঠকের পর এক অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্য। আর খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির হাল ধরার দায়িত্ব তিনি কাকে দিতে পারেন- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দলের অনেকেই হয়তো সংশয় ও অস্থিরতায় ভুগছেন। তবে এটা সত্য যে, বিএনপি বিগত দিনের মতো সব সংকট সামলে নিতে পারবে এবং কোন অনাক্সিক্ষত কিছু যদি ঘটে, তখন নিশ্চয় দেশনেত্রী সঠিক একটি নির্দেশনা দেবেন আমাদেরকে।’ 

হঠাৎ করে দলীয় প্রধানের সাজা হলে দলটির মূল নেতৃত্ব সংকটে পড়তে পারে কিনা- এক প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘এমন আশঙ্কা হয়তো কেউ কেউ করছেন; তাদের এই আশঙ্কা ঠিক নয়, কারণ আমার বিশ্বাস- পরবর্তী নেতৃত্ব মনোনয়নে শেষ মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপারসন সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।’ 

দলীয় একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান সময়ের মতো এমন রাজনৈতিক সংকটে এর আগে আর কখনো পড়েনি। সংশ্লিষ্ট এই সূত্রের দাবি, বিএনপির  চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শুভাকাক্সক্ষীমহল দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেসহ দলটির প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকদের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে দলের কূটনৈতিক বিষয়াদি দেখভাল করেন এমন একজন সিনিয়র নেতা বলেন, বিএনপির ঘনিষ্ট বেশ’কটি প্রভাবশালী দেশও চাচ্ছে, বিএনপি যে কেনো সংকট কাটিয়ে উঠতে ‘ক্লিন ইমেজ’র নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে ইতিবাচক রাজনীতির পথে চলুক। বিশেষ করে দলটির অতীতের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাক। আর তা করতে গেলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে যিনিই হাল ধরুন না কেন, দল পরিচালনা ও আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি পালনের কৌশল নির্ধারণ অতীতের মতো মা ও ছেলের হাতেই থাকবে। 

এদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দাবি- আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ফাঁদ পেতেছে। বিএনপি প্রধানকে সাজার জালে আটকিয়ে আগামী নির্বাচনে তাকে অযোগ্য করার কৌশল গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি প্রধানের বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বুধবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে জেলে পাঠালে এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপরসনকে জেলে পাঠিয়ে যদি জাতীয় নির্বাচন দেয়া হয়, দেশের মানুষ এ নির্বাচন মেনে নিবে না। দেশ প্রেমিক কোন দল এ নির্বাচনে অংশ নিবে না।’ 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেয়া বক্তব্যের পরের দিন গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানোর ইচ্ছা সরকারের নেই। কার কী সাজা হবে বা মাফ করা হবে তা আদালতের বিষয়। সময় এবং স্রোত কারো জন্য যেমন অপেক্ষা করে না, তেমন সংবিধান এবং নির্বাচনও কারো জন্য অপেক্ষা করবে না।’ তিনি বলেন, ‘আদালতে কেউ সাজাপ্রাপ্ত হলে নির্বাচন কারো জন্য বসে থাকবে না। যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’

এছাড়া ‘খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচন হতে পারবে না’ বলে বিএনপির হুঁশিয়ারির প্রতিক্রিয়ায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আদালতে দোষী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি হবেই। যদি কোর্টের কাছে প্রমাণ থাকে চুরি করেছে, তাহলে শাস্তি হবে। সেজন্য তারা ইলেকশনই হতে দেবে না। একটা চোর এতিমের টাকা যে চুরি করে খায় তাকে রক্ষার জন্য ইলেকশন হতে দেবে না- কত আবদারের কথা, কত আহ্লাদের কথা! এত আহ্লাদ যখন, তখন গরিব মানুষের টাকা কয়টা দিয়ে দিলেই হতো।’

জার্মানির মিউনিখের ম্যারিয়ট হোটেলে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার বিকেলে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। সংশ্লিষ্ট মামলায় বিচারিক আদালতের প্রতি অনাস্থা এনে উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার আবেদনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা মামলার জন্য হাইকোর্টে ৫৩/৫৪ বার পিটিশন করেছে। এখন মামলা থেকে পালায়। মিথ্যা মামলা হলে পালানোর কী দরকার? এটা তো পরিষ্কার- এতিমখানার টাকা মেরে খেয়েছে। এটা তো কাগজপত্রে আছে।’

প্রসঙ্গত, ২০০১-০৬ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা দুর্নীতির দুই মামলা এখন বিচারের শেষ পর্যায়ে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলা দুটি চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই