কুসিক নির্বাচন নিয়ে সংশয়

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০১৭, ০৯:৫৩ পিএম

ঢাকা: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্থানীয় সরকার জন-প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে চায় নির্বাচন কমিশন। এদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর। নির্বাচনে এই প্রথম জনপ্রতিনিধি সম্পৃক্ততার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন বিতর্ক উঠেছে নানা মহলে। 

একদিকে, যেমন বিষয়টি নতুন ও এ ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণাও নেই কারো; একইভাবে এর জন্য পৃথক কোনো কাঠামো ও পরিকল্পনাও তৈরি করতে পারেনি ইসি। ফলে শেষ পর্যন্ত ইসির এই সিদ্ধান্ত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখে-প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে।

গত ৯ মার্চ রাজধানীতে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠকে কুসিক নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তের ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচান কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। পরে সে ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দেখা দেয়। রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের অভিমত, সিটি নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হলে নির্বাচন তার নিরপেক্ষতা হারাবে। তারা কমিশনের এ ধরনের চিন্তা ও পরিকল্পনাকে ‘উদ্ভট’ ও ‘কল্পনাপ্রসূত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ’ বলেও মত দেন।

বিশ্লেষকরা এমনও মনে করছেন, দলীয় নির্বাচনে দলীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার অর্থই হলো নতুন সংকটের দিকে নির্বাচনকে ঠেলে দেয়া। যেখানে নির্বাচন থেকে এসব জনপ্রতিনিধিদের দূরে রাখতে ও প্রভাববিস্তার ঠেকাতে কমিশন সরকারের হস্তক্ষেপ চায়; সেখানে উল্টো তাদের সম্পৃক্ত করার অর্থই দুরভিসন্ধি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে উদ্ধুদ্ধকরণ ছাড়া অন্য কোনো কাজে এসব জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ত করা হলে তা কমিশনের জন্য বুমেরাং হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আগামী ৩০ মার্চ কুসিক নির্বাচন। মুল প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় প্রার্থী। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু না হলেও প্রচারণার ব্যাপক প্রস্তুতির আভাস মিলেছে দুদলেই। গত ২০ ফেব্রুয়ারি এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। আগামী ১৪ মার্চ প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ এবং সেদিন থেকেই প্রচারণা শুরু হবে।

কুসিক নির্বাচন, গাইবান্ধা-১ ও সুনামগঞ্জ-২ আসনের উপনির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে গত ৯ মার্চ আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বৈঠক করে ইসি। সে বৈঠকে সিইসি কে এম নুরুল হুদা জানান, এই নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হবে। তবে তাদের কাজের ধরন কি হবে তা খোলসা করেননি সিইসি। তার ওই বক্তব্যের জবাবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক তাদের (জনপ্রতিনিধি) নির্বাচনে সম্পৃক্ত করার কাঠামো কি হবে জানতে চাইলে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সিইসি।

তবে এ ব্যাপারে ইসির কোনো প্রস্তুতি ও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলে জানিয়েছেন ইসির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব কর্মকর্তা বলেন, বিগত কমিশনগুলো নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম কর্মীদের নির্বাচনে কমিশনকে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানাতেন। তারা বলতেন, কমিশনের একার পক্ষে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি এবারই প্রথম আসছে। তবে সম্পৃক্ততার পরিবর্তে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে জনপ্রতিনিধিরদের সম্পৃক্ত করার পক্ষে মত ইসির কর্মকর্তাদের।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে স্থানীয় সরকারের সব প্রতিনিধিই দলীয়। তাদের কাছে নিজ দল ও দলীয় প্রার্থীই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে এসব প্রতিনিধি ও তাদের সমর্থিত দলীয় নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকে না।

নির্বাচন ইস্যুতে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আর জেলা পরিষদ ছাড়া সব নির্বাচনই দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার ইউপির অধিকাংশই চেয়ারম্যান, মেম্বর ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বর ক্ষমতাসীন দলীয়। ফলে তাদের এ নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা হলে অন্য দলের প্রার্থীরা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সমান সুবিধা পাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে।

বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন, কুসিক নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তের কাঠামো কি হবে তা নির্ধারণ করা জরুরি। তা না হলে নতুন সংকটে পড়বে ইসি। এমনকি এ নিয়ে বিতর্কের মুখেও পড়তে পারে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসি। বিশেষ করে কুসিক নির্বাচন এই ইসির জন্য নিরপেক্ষতা প্রমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। সে জন্য ইসির খুব সতর্ক থাকতে হবে।

জানতে চাইলে সদ্য বিদায় নেয়া ইসির নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, জনপ্রতিনিধিদের কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত করতে হলে তাদের কাজের পরিধি কি হবে তার কাঠামো আগেই ঠিক করে নিতে হবে। কারণ জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে একটা আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর যদি সম্পৃক্ত করতেই চায়, তা হলে কেবল ভোটারদের উদ্বুদ্ধকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই শ্রেয় হবে। এর বাইরে অন্য কোনো চিন্তা করা হলে নির্বাচন পরিকল্পনা পুরোটায় ভ-ুল হয়ে যেতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা হলে নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে বলে আমার মনে হয় না। এতে নির্বাচন নিরপেক্ষতা হারাতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। জন-প্রতিনিধিদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তাদের সম্পৃক্ত করা হলে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার হবে, নির্বাচনের সঠিক ফলাফলটা আসবে না।

অবশ্য কিভাবে সম্পৃক্ত করবে কমিশন-সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সু-শাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়। নির্বাচনে দলীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা হলে আরো জটিলতা সৃষ্টি হবে এবং পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন এড়ানো যাবে না। কারণ তারা প্রায় সবই দলীয় ব্যক্তি। এ ছাড়া তারা নির্বাচনী কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কিংবা নির্বাচনের পর্যবেক্ষকও নয়। এই নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কি হবে তা আমার বোধগম্য নয়।

অবশ্য কুমিল্লার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দীন মন্ডল বলেন, যারা জনপ্রতিনিধি আছেন বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বর রয়েছেন তাদেরকে এ নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা হবে। নির্বাচনটিকে উৎসবমুখর করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

তবে, কোনো দলীয় পক্ষ নয়, নিরপেক্ষ জনপ্রতিনিধিদের এতে সম্পৃক্ত করা হবে, যাতে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে আসেন। তবে দলীয় জনপ্রতিনিধিরা দলের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ থেকে কাজ করতে পারবে কি না এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি এই কর্মকর্তা।

আর কুমিল্লার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহ আবিদ হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, হয়তো নির্বাচনের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত করতে চাইছে ইসি। তবে এর কোনো কাঠামো বা ধারণা তিনি এখনো পাননি বলেও জানান।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন